রহমত রহমান: আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস খাতে প্রতিনিয়ত মামলার সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা। বেশিরভাগ মামলায় সরকার পক্ষ হেরে যায়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষেও রায় চলে যায়। আবার অনেক মামলার মেরিট অনুযায়ী উভয় পক্ষে রায় হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেয়া রায়ের বেশিরভাগ সরকারের পক্ষে যাচ্ছে। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ভ্যাট ও কাস্টমস খাতের বেশিরভাগ মামলায় সরকারের পক্ষে রায় হয়েছে। আয়কর খাতে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা বাড়লেও সরকারের পক্ষে রায় কম আসছে। কর্মকর্তারা বলছেন, মামলা তদারকি বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের পক্ষে রায় বেশি হচ্ছে। মূলত শুল্ককর ও ভ্যাট ফাঁকি, আমদানি-রপ্তানিতে জালিয়াতিসহ বিভিন্ন কারণে শুল্ক ও ভ্যাট খাতে মামলা হয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) দেয়া তথ্যে এসব উঠে এসেছে।
সূত্রমতে, ২৯ নভেম্বর আইআরডি সম্মেলন কক্ষে আইআরডি ও এর আওতাধীন দপ্তর, সংস্থার মাসিক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন আইআরডির জ্যেষ্ঠ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। সভায় কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা, নিষ্পত্তি ও অনিষ্পন্ন মামলার হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। যাতে দেখা গেছে, গত অক্টোবরের শুরুতে অনিষ্পন্ন মামলা ছিল ৩৬০টি। আর অক্টোবর মাসে দায়ের হয়েছে ১৩১টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬৫টি ও অনিষ্পন্ন রয়েছে ৩২৬টি মামলা। তুলনা করা হলে আগের বছর অক্টোবরে মামলা হয়েছে ১৬০টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৮৪টি।
অক্টোবর মাসে নিষ্পত্তি করা মামলার হিসাবে দেখা গেছে, অক্টোবর মাসে কাস্টমস খাতে নিষ্পত্তি করা মামলায় সবচেয়ে বেশি রায় সরকারের পক্ষে এসেছে। অক্টোবর মাসে কাস্টমসের ১১২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যা বিভিন্ন কাস্টম হাউস, শুল্ক স্টেশন রাজস্ব ফাঁকি এবং আমদানি-রপ্তানিতে জালিয়াতি-সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন সময় দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭টি মামলা সরকারের পক্ষে, ৩৭টি মামলা সরকারের বিপক্ষে ও ১৮টি মামলায় উভয় পক্ষে (সরকার ও আমদানি-রপ্তানিকারক) রায় হয়েছে। অর্থাৎ অক্টোবর মাসে নিষ্পত্তি করা ১১২টি মামলার মধ্যে ৫০ দশমিক ৮৯ শতাংশ মামলার রায় সরকারের পক্ষে, ৩৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ সরকারের বিপক্ষে ও ১৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ উভয় পক্ষের রায় হয়েছে।
অপরদিকে অক্টোবর মাসে ভ্যাট-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে সরকারের পক্ষে রায় বেশি এসেছে। অক্টোবর মাসে মোট ভ্যাটের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৩টি মামলা। এর মধ্যে ২৪টি মামলার রায় সরকারের পক্ষে, সাতটি মামলা সরকারের বিপক্ষে ও ২২টি মামলা উভয় পক্ষে (সরকার ও আমদানি-রপ্তানিকারক) রায় হয়েছে। অর্থাৎ অক্টোবর মাসে নিষ্পত্তি করা ৪৫ দশমিক ২৮ শতাংশ রায় সরকারের পক্ষে, ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ রায় সরকারের বিপক্ষে ও ৪৫ দশমিক ৫১ শতাংশ উভয় পক্ষে রায় হয়েছে। আর অক্টোবর
মাসে কাস্টমস ও ভ্যাটের মোট ১৬৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৮১টি মামলার অর্থাৎ ৪৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ রায় সরকারের পক্ষে হয়েছে। আর ৪৪টি অর্থাৎ ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ সরকারের বিপক্ষে এবং ৪০টি মামলা অর্থাৎ ২৪ দশমিক ২৪ শতাংশ রায় উভয় পক্ষের হয়েছে।
অন্যদিকে অক্টোবর মাসে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মোট ১৫৫টি আপিল দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ১৫১টি প্রতিষ্ঠান ও চারটি সরকার পক্ষ আপিল করেছে। আর উভয় পক্ষে দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে কোনো আপিল দায়ের করা হয়নি।
আইআরডির হিসাব অনুযায়ী, ভ্যাট ও কাস্টমস মামলায় সরকারের পক্ষে রায় বেশি এলেও আয়করের ক্ষেত্রে তা উল্টো। ট্যাকসেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি করা মামলায় সরকারের পক্ষের চেয়ে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বেশি রায় হয়েছে। হিসাবে দেখা গেছে, অক্টোবর মাসের শুরুতে আয়করের অনিষ্পন্ন মামলা ছিল ৬৯৫টি। মামলা দায়ের করা হয়েছে ৫৬০টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৯৫টি এবং অনিষ্পন্ন রয়েছে ৮০০টি। গত বছরের অক্টোবরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, গত বছর অক্টোবর মাসে মামলা দায়ের হয়েছে ৭৩১টি, যা চলতি বছর অক্টোবরে হয়েছে ৫৬০টি। গত বছর অক্টোবরে নিষ্পত্তি হয়েছে এক হাজার ১৭৯টি এবং চলতি বছর অক্টোবরে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৯৫টি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে উভয় পক্ষে মোট ১৫৮টি রায়ের আদেশের কপি সংগ্রহ করা হয়েছে। এ তথ্য থেকে দেখা গেছে, প্রতিমাসে গড়ে ৫৩টি মামলা উচ্চ আদালতে গেছে।
সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান দুই ট্রাইব্যুনালের মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতিমাসে সরকারের পক্ষে, বিপক্ষে ও উভয় পক্ষে রায় হওয়া কী পরিমাণ মামলা উচ্চ আদালতে যায়, তা সমন্বয় করে জানাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মামলার তথ্য সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও এর আওতাধীন দপ্তরে বিভাগীয় এবং প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের মামলার সংখ্যা কমেছে। হিসাবে দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন প্রশাসন, কর, শুল্ক ও সঞ্চয় অধিদপ্তরের বিভাগীয় অনিষ্পন্ন মামলা রয়েছে চারটি। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে কোনো মামলা নেই। এনবিআর ও এর আওতাধীন বিভাগীয় অনিষ্পন্ন মামলা রয়েছে ৭৮টি। সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান নির্দেশ দেন যে, দাপ্তরিক প্রয়োজনে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু করতে হবে। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ছুটি, প্রেষণ বা লিয়েন নিয়ে দেশে বা বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা চাকরিতে গেছেন, কিন্তু অনুমোদিত মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার বেতন-ভাতা বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন দপ্তর ও সংস্থায় শূন্য পদ পূরণে পদক্ষেপ নিতে চেয়ারম্যান নির্দেশ দিয়েছেন। সভায় বলা হয়, ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে শূন্য পদ পূরণে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। হিসাবমতে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ৭৫টি দপ্তর ও সংস্থায় শূন্য পদের সংখ্যা ছিল চার হাজার ২০৩টি। এর মধ্যে সরাসরি নিয়োগযোগ্য শূন্য পদ ছিল দুই হাজার ৯২৫টি। এরই মধ্যে ৪৪টি দপ্তর ও সংস্থার অফিসে এক হাজার ৭৯৯ জনকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। আরও কিছু শূন্য পদ পূরণে নিয়োগ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।