রাতের ব্যস্ততাকে সঙ্গী করে একদল শিক্ষার্থীর যাত্রা শুরু হয় সেদিন। প্রথম গন্তব্য রাজশাহী রেলস্টেশন। সেখান থেকে রাত ১০টায় চেপে বসে তারা ধূমকেতু ট্রেনে। ট্রেনে উঠে সেলফিবন্দি হলেন তারা। কিছুক্ষণের মধ্যে বন্ধু আলমাস তার ফেসবুক টাইমলাইনে সেই ছবি পোস্টও করেন। সেই শুরু হৈ-হুল্লোড়ের। তবু নির্ঘুম রাত যেন কাটেই না! গান-গল্পের আড্ডায় সবাই
ক্লাস-পরীক্ষার কথা ভুলে গেছে। ভোর ৬টায় সিলেটগামী জয়ন্তিকা ট্রেনে সবাই চেপে বসে। ট্রেন ছুটে চলে আপন গন্তব্যে। নিয়মিত বিরতিতে নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার পাড়ি দিয়ে ট্রেনটি সিলেট স্টেশনে পৌঁছায়। সেখান থেকে আগে থেকে বুকিং দেওয়া হোটেলে পৌঁছে রাত্রি যাপন করে তারা। এতক্ষণ বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিস্ট ক্লাবের সদস্যদের কথা। গত ২৩ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত এই আনন্দ ভ্রমণে অংশ নেয় ক্লাবের ২৫ সদস্য। প্রতিবছরের মতো ক্লাবের পক্ষ থেকে এই আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন করা হয়।
তিন দিনব্যাপী আনন্দ ভ্রমণে আমিও ছিলাম। প্রথম দিনে আমরা মানে ক্লাবের সদস্যরা সিলেটের আগুন পাহাড়, জাফলং, খাসিয়া পল্লি ও চা বাগান ঘুরে দেখি। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে আগুন পাহাড়ের পথে লেগুনায় রওনা দিই। লেগুনা সিলেট নগরীর কিন ব্রিজ পাড়ি দিয়ে এগুতে থাকে। সঙ্গে রয়েছে সিলেটের বর্ষাঘন আবহাওয়া। দূরের পথ ধরে যেতে চোখে পড়ে উঁচু উঁচু টিলার সারি সারি চা বাগান। মেঘালয়ের পাহাড়গুলোও যেন তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতেই দেখা মিলে আগুন পাহাড়ের। নামের সঙ্গে এ পাহাড়ের অদ্ভুত মিল রয়েছে। আনন্দে ভয়কে জয় করে বিপ্লব দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালাই। আগুন জ্বালিয়ে নিজেকে জাদুকর প্রমাণের চেষ্টা করি। এদিকে পাহাড়ের কিনারায় উঠে সেলফি তুলতে ব্যস্ত সময় পার করেন আরিফিন।
পরে যাত্রা শুরু করি জাফলংয়ের পথে। সেখানে পৌঁছে দুপুরের খাবার খেয়ে নেমে পড়ি নদীর পাড়ে। ভাড়া করা নৌকা দুটো ছুটে চলে। কয়েক মিনিটের পথ পাড়ি দিতে চোখে পড়ে মেঘালয় থেকে নেমে আসা জাফলং ঝরনা। ঝরনাকে সঙ্গী করে নিজেদের ফ্রেমবন্দি করি। আনন্দ ভ্রমণের সমন্বয়ক বন্ধু শামিম জাফলংয়ে এক ঘণ্টা অবস্থানের কথা জানিয়ে দেয়। কিন্তু সময় ধরে-বেঁধে কি আর আনন্দ করা যায়? আনন্দ আড্ডায় ঝরনার পানিতে আমরা দুই ঘণ্টা অতিবাহিত করি। সেখান থেকে অটোরিকশায় চেপে খাসিয়া পল্লির পথে চলতে থাকি। পুরো পল্লি সাজিয়ে নিয়েছে সিলেটের খাসিয়ারা। পল্লির ছোট ছোট খুপরিগুলো অপার সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। সন্ধ্যার আকাশে সূর্যের আলো ক্ষীণ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবের সদস্যরা ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করে।
দ্বিতীয় দিন সিলেটের স্বর্গ বিছানাকান্দি ও রাতারগুলের সৌন্দর্য দর্শনে বের হই। সকাল সকাল প্রস্তুতি সেরে লেগুনায় চড়ে বসি সবাই। ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রাতারগুলে পৌঁছে যাই। ঘাটে বাঁধা সারি সারি নৌকা দর্শনার্থীদের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। জলে নিমজ্জিত করচ গাছের ভেতর দিয়ে পাঁচটি নৌকায় এগুতে থাকে। নৌকাগুলো আঁকাবাঁকা জলপথ বেয়ে চলতে থাকে। নৌকার মাঝিদের সঙ্গে গান গাইতে থাকে আসাদ, দৃষ্টি, তাজ, রবিন, রতন, রিপন, সাব্বির, রোজ ও শ্যামা। বনের মধ্যে ওয়াচ টাওয়ারের কাছে পৌঁছাতেই রাতারগুলের চারপাশের সৌন্দর্যদর্শনে মুগ্ধ হয়ে যাই।
সেই সৌন্দর্যদর্শনের কথা বলছিল ক্লাবের সদস্য তাসনিম জাহান। বনের ভেতর দিয়ে পানিপথের রাস্তাগুলো দেখতে অসাধারণ। ছবির পথগুলো যেন আজ সত্যিকার পথে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ওয়াচ টাওয়ারের ওপরে উঠে চারদিকে তাকাতেই দু’চোখ যতদূর যায় শুধু পানি আর সারি সারি করচ গাছ। এমন অপরূপ সৌন্দর্য হƒদয়ের সিংহাসন দখল করে নিয়েছে।
সেখান থেকে ভাড়া করা লেগুনায় চড়ে বিছানাকান্দির পথে এগুতে থাকি। পীরের বাজার ঘাটে পৌঁছাতেই লেগুনার চালক জানান, এখানে থেকে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই মিলবে বিছানাকান্দি। আবারও ভাড়া করা নৌকায় যাত্রা শুরু। নদীর বিস্তীর্ণ জলরাশি ভেদ করে চলতে থাকে নৌকা দুটো। নদীপথ ধরে এগুতে দু’ধারে চোখে পড়ে ছোট ঘরবাড়ি। আর পথিমধ্যে দেখা যায় ছোট যাত্রীবাহী নৌকা ও পাথরবোঝাই ট্রলারের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিস্ট ক্লাবের সভাপতি মাহফুজ মুন্না বলেন, ক্লাস-পরীক্ষার ফাঁকে ক্লাবের সদস্যরা মিলে প্রায়ই ঘুরতে যাই। কয়েক দিনের প্ল্যানে আমরা সিলেটে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আনন্দ আর হৈ-হুল্লোড়ে তিন দিন কেটে যায়। ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রতিবছর এ রকম ট্যুরের আয়োজন করা হয়। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে সবার সামনে মেলে ধরতেই ট্যুরিস্ট ক্লাবের এই আয়োজন।
নৌকা ছুটে চলে আপন গতিতে। যতদূর চোখ যায়, দেখা মেলে নীল আকাশঘেঁষা সবুজ পাহাড়। মেঘ আর আকাশি রঙে মিলে একাকার হয়ে গেছে পাহাড়ের গাছগুলোর সবুজ প্রকৃতি। যতই এগুতে থাকি পাহাড়ের নৈকট্য যেন বাড়তেই থাকে। বিছানাকান্দির পিয়াইন নদীর স্রোতে নিজেদের শান্ত করতে নেমে পড়ি। পাথরের গা-ঘেঁষে বসে সবাই ছবি তোলার কাজটিও সেরে ফেলি। দুই ঘণ্টার জলবিলাসের গল্প নিয়ে ভাড়া করা নৌকায় চেপে বসি। সেখান থেকে এবার ফেরার পালা। ঝিরঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হোটেলে সবাই ফিরে আসি।
পরদিন দেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড ঘুরে দেখার পালা। সকালে লোকাল বাসে চড়ে মাধবকুণ্ডে পৌঁছাই। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ও চা বাগান দেখতে দেখতে আনন্দ ভ্রমণের সময় ফুরিয়ে আসে। রঙিন স্মৃতির ক্যানভাসে মনের গ্যালারি যখন পরিপূর্ণ তখন সময়ের প্রয়োজনে প্রিয় মতিহারের সবুজ চত্বরের পথে রওনা দিই। আর চাঁদ-তারার আলোতে আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগুতে এগুতে সবার কণ্ঠে শোনা যায়Ñএই পথ যদি না শেষ হয়…
আলী ইউনুস হৃদয়
ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল
ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল যুক্তরাষ্ট্রের
মেরিল্যান্ডভিত্তিক একটি খ্যাতনামা হোটেল চেইন। এর মালিকানাধীন বিশ্বের ১২৭ দেশে ৩০টিরও বেশি হোটেল ব্র্যান্ড ও সাড়ে ছয় হাজারের বেশি হোটেল রয়েছে।