Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 5:32 pm

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চার বছর: এখনও লাশের খোঁজে স্বজনরা

জাহিদ হাসান, সাভার : আজ ২৪ এপ্রিল। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চার বছর অতিক্রম করল বাংলাদেশ। পোশাক খাতের নিরাপত্তা ও সক্ষমতা নিয়ে অনেক অগ্রগতি আলোচনায়। কিন্তু এখনও কেউ কেউ খুঁজে ফিরছেন নিহত স্বজনের লাশ। রানা প্লাজার সেই ফাঁকা জায়গায় এসে হাউমাউ করে কাঁদেন কারও কারও মা-বোন। ট্র্যাজিক এই দিনটিতে নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের আহাজারি যেন বেড়ে যায় আরও।

এদিকে এ ঘটনায় দায়ের হওয়া তিনটি মামলার ধীরগতিতে হতাশ অনেকে। অভিযোগপত্রে ৪০ জন আসামির নাম রয়েছে। এর মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ তিনজন। ৩০ জন রয়েছেন জামিনে। পলাতক রয়েছেন আরও সাতজন। দ্রুত এসব মামলার কার্যক্রম চালিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্বজনহারা ব্যক্তিরা।

গতকাল রোববার রানা প্লাজার পরিত্যক্ত জায়গায় গিয়ে দেখা যায়, লাশের হদিস না পাওয়া স্বজনদের অনেকেই সেখানে হাজির হয়েছেন। প্রতিবছরই সেখানে যান তারা। নিখোঁজদের অনেকের বৃদ্ধা মায়েরা মাঝে মধ্যেই এসে বসে থাকেন সেখানে।

ঢাকার দোহার থানার ববিতা বেগমের আহাজারি, ‘শুধু লাশটা চাই, শেষবারের মতো ছেলেটাকে দেখমু, গোসল করায়া কবরে দিমু।’ তার ছেলের নাম মনির হোসেন। দোহার থেকে সাভারে এসেছিলেন। কাজ করতেন রানা প্লাজার চতুর্থ তলার প্যানথম ট্যাক নামের কারখানায়। ধসে পড়া রানা প্লাজার নিখোঁজদের তালিকায় রয়েছে ২৫ বছরের এ যুবকের নাম। দেখতে দেখতে চার বছর পেরিয়ে গেলেও তার মা ববিতা বেগম এখনও পথ চেয়ে আছেন, খোকা আসবে।

তিনি জানান, ‘চার বছর আগে ভবনধসের খবর পেয়ে দোহার থেকে ছুটে আসেন সাভারের রানা প্লাজার সামনে। সেখান থেকে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে, যেখানে রাখা হয়েছিল লাশগুলো। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। বেওয়ারিশ লাশের দাফন করেছিল আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। তাদের তালিকায়ও নেই মনিরের নাম। ববিতা বেগমের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু খোঁজ মেলেনি তার ছেলের।

এমন অনেকেই জানেন না তাদের প্রিয়জনের খোঁজ। পাবনার আতাইকুলা এলাকার আছাব আলী খন্দকারের মেয়ে ফারজানা আক্তার (১৮) কাজ করতেন প্যানথন গার্মেন্টসে। থাকতেন বোনের বাসায়। ভবনধসের খবর পেয়ে তার বোন গিয়েছিলেন রানা প্লাজার সামনে। তারও ডিএনএ রেকর্ড রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার খোঁজ মেলেনি।

গত শনিবার দুপুরে নিখোঁজ ফারজানার বড় বোন লিপি আক্তারের সঙ্গে কথা হয় রানা প্লাজার সামনে। ভবনধসের চার বছর পার হয়ে গেলেও এখনও ছোট বোনের লাশ খুঁজে পাওয়ার আশা ছাড়েনি তিনি। বোনের ছবি হাতে নিয়ে ছুটে এসেছেন ধসেপড়া ভবনের সামনে। সরকার নামমাত্র কিছু সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু তাদের মা-বাবা আজও মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এদিকে ভবনধসের ঘটনায় জড়িতদের বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি। অবিলম্বে দোষীদের বিচার শেষ করে রানার ফাঁসির দাবি জানান স্বজনরা।

রংপুরের দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী বেবী বেগম (৩৫)। এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে সাভারের সিআরপি এলাকায় ভাড়া থাকতেন। স্বামী সিআরপিতে কাজ করতেন। বেবী বেগম রানা প্লাজার ছয়তলার ইথার টেক্স কারখানায় সুইং অপারেটরের চাকরি করতেন। তারও সন্ধান মেলেনি। তার স্বজনরা বলছেন, ‘যাদের কারণে তারমতো এরকম শত শত মানুষ স্বজনহারা হয়েছেন, তাদের এখনও বিচার হয়নি।’ অবিলম্বে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি জানান তারা।

জানা গেছে, রানা প্লাজার মামলা হলেও এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। সাভারে রানা প্লাজায় ভবনধসের ঘটনায় হত্যা মামলা ও ইমারত নির্মাণ আইনে করা মামলায় ওই ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এ ট্র্যাজেডির পর হত্যা মামলায় ৪১ জনকে ও ইমারত নির্মাণ আইনে করা মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়। সে হিসেবে দুই মামলার আসামি ৫৯ জন। এর মধ্যে ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে থাকায় মোট আসামি ৪২ ব্যক্তি। পরে হত্যা মামলায় সিদ্দিকুর রহমান নামে এক আসামির মৃত্যুর ফলে এখন ৪১ জন আসামি। এছাড়া তৎকালীন ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক শাহিন শাহ পারভেজ শুধু সোহেল রানাকে আসামি করে ধামরাই থানায় অস্ত্র আইন ও মাদকদ্রব্য আইনে দুটি মামলা করেছিলেন। এ দুটি মামলার অভিযোগপত্র আগেই দেওয়া হয়েছে।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা। দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম এ শিল্প দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৩৮ জন নিহত হন। আহত ও পঙ্গু হয় প্রায় দুই হাজার মানুষ। মর্মান্তিক এ ঘটনা নিয়ে মোট পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় সাভার থানায় একটি মামলা করেন। একই দিন সাভার মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ একই থানায় আরও একটি মামলা করেন। পুলিশের করা মামলায় রানা প্লাজার ধসকে অবহেলাজনিত মৃত্যু চিহ্নিত করে অভিযোগ আনা হয়। এ বিষয়ে মামলার বাদী ঢাকা জেলার পিপি অ্যাডভোকেট খন্দকার আবদুল মান্নান জানান, গত বছরের ১৮ জুলাই অভিযোগ গঠন করা হয়। পুলিশের করা হত্যা মামলায় ৪১ জনকে আসামি করা হয়। রাজউকের ইমারত নির্মাণ মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়। বর্তমানে সোহেল রানাসহ তিনজন কারাগারে রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জন জামিনে ও সাতজন পালাতক। সিদ্দিকুর রহমান নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আগামী ৭ মে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন আদালত। সাক্ষীদের তালিকায় ৫৯৪ জনের নাম রয়েছে। তবে আসামিপক্ষ সাক্ষ্য গ্রহণ স্থগিত করার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেছে। তবে আমরা সব মিলিয়ে কাজ করছি। দ্রুত আমরা রায় পাবো।