নিজস্ব প্রতিবেদক : রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত এক শ্রমিক বাকী বিল্লাহ। তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে সাভারের ইপিজিডের অন্তর্ভুক্ত এফসিআই গ্রুপের একটি কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু, সেখান থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি বেকার।
দুর্ঘটনার চার বছর পেরিয়ে গেলেও বাকী বিল্লাহর মতো বেকার রয়েছেন অনেক শ্রমিক। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন এইডের এক প্রতিবেদন অনুসারে রানা প্লাজার দুর্ঘটনাকবলিত শ্রমিকদের ৪২ দশমিক চার শতাংশ এখনও বেকার। শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতার কারণেই সিংহভাগ বেকার রয়েছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার চার বছর স্মরণে ‘অবিস্মরণীয় অমার্জনীয়: রানা প্লাজা’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গতকাল শনিবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রকাশ করা হয়। এতে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক ও নিহতদের পরিবারের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দিয়েই দায় শেষ হবে না। তাদের প্রকৃত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেজন্য সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে এক হাজার ৪০৩ জন আহত শ্রমিক ও ৬০৭ জন নিহত শ্রমিকের স্বজনের মধ্যে জরিপ চালানো হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, এসব শ্রমিকের অধিকাংশই ৩০ বছরের কম বয়সে পঙ্গু অথবা অক্ষম হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে সাড়ে ৭৪ শতাংশ শ্রমিকের শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলেও ১৩ শতাংশ শ্রমিকের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এছাড়া উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ শ্রমিক এখনও মানসিকভাবে অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যদিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ৪২ দশমিক চার শতাংশ শ্রমিকই বেকার রয়েছেন।
অবস্থার উত্তরণের জন্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা এড়াতে যে কোনো কারখানার অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান চালানো জরুরি। এজন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি আহত শ্রমিকদের জীবনব্যাপী সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য ‘নিরাপত্তা তহবিল’ গঠন করতে হবে। শ্রমনীতি ও শ্রম আইনের মধ্যকার অসঙ্গতি দূর করে শ্রমিক-বান্ধব নীতি প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থসামাজিক অবস্থার নিরসনে উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া শ্রমিকদের মতামত দেওয়ার সুযোগ দিতে প্রকৃত অর্থেই যাতে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবিরের পরিচালনায় এ অনুষ্ঠানে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ বোর্ডের চেয়ারপারসন ড. খলিলুর রহমান, ওয়ার্কার্স সেফটি ফোরামের আহ্বায়ক ড. হামিদা হোসেন, বিশ্ব শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক তুমো পুতিয়ানিন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন, অ্যালায়েন্সের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর পল অ্যাডওয়ার্ড রিগবি, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ্ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এ সময় রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
সভায় আইএলও’র প্রতিনিধি তুমো পুতিয়ানিন বলেন, রানা প্লাজার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে নিরাপত্তার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। নিরাপত্তা হচ্ছে বিনিয়োগের মতো। এটা কোনো খরচ নয়। এর ফলাফল দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যায়। তিনি ক্ষতিপূরণের জন্য ইউনিভার্সাল এমপ্লয়মেন্ট ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। এজন্য উৎপাদক, ক্রেতা, শ্রমিক ও সরকারের বহুপাক্ষিক উদ্যোগ জরুরি বলেও তিনি মত দেন।
সিপিডির মেয়াজ্জেম হোসেন বলেন, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। কারখানা সংস্কারের জন্যও সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু, রানা প্লাজার শ্রমিকদের জীবনের কান্নার কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি, যা অমানবিক। তাদের সহায়তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ দরকার। তাদের আজীবন মেয়াদি সহযোগিতা প্রয়োজন। সেজন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ দরকার। দুর্ঘটনার পর হাইকোর্ট থেকে যে কমিটি করা হয়েছিল তারা যথেষ্ট মানসম্মত প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু, অনেকের অসুস্থতা সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়নি। কিন্তু, সেই ট্রাস্ট ফান্ডের হিসাবের পুরো টাকা শ্রমিকরা ও তাদের আত্মীয়রা একবারে পায়নি। এখন তাদের মাত্র ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা সঞ্চয় বাকি আছে। এটা দিয়ে তাদের জীবন চলবে না। তাদের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করতেই হবে।
সভায় বক্তারা আহত শ্রমিকরা আর্থিক সংকটের পাশাপাশি নানা রকম সামাজিক সংকটে পড়ছেন বলেও উল্লেখ করেন। নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে একজন আহত শ্রমিক জানান, আহত হওয়ার কিছুদিন পর তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। সাড়ে চার শতক জমি ছিল তার মালিকানায়। চিকিৎসার জন্য তা বিক্রি করে এখন ভূমিহীন তিনি। তার মেরুদণ্ডের হাড় শক্ত হয়ে আছে। বুকের পাঁজর ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। গ্রামের কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। কেউ খোঁজ-খবরও নেয় না। তার কোনো মতামতও শোনা হয় না।
নিলুফা ইয়াসমিন নামের অপর এক শ্রমিক জানান, সরকারি হাসপাতালেও তাদের জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয় না। বেসরকারি হাসপাতালে গেলে তাদের বলা হয়, রানা প্লাজার শ্রমিকরা এখন ‘কোটিপতি’। বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হবে না। অথচ, সরকার থেকে আমরা ৫-১০ হাজার টাকা অনুদান পাই। তার মধ্য থেকে সাড়ে তিন হাজারই চলে যায় চিকিৎসার কাজে। আমরা প্রকৃত ক্ষতিপূরণ চাই।

Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 8:43 pm
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ৪ বছর, শ্রমিকদের ৪২ শতাংশ এখনও বেকার
শেষ পাতা ♦ প্রকাশ: