পেটে প্রচণ্ড ব্যথাসহ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে সম্প্রতি রাজশাহী এসেছিলেন চুয়াডাঙ্গার আজমা খাতুন। জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দুধপাতিলায় বাড়ি তার। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানতে পারেন, লিভারসংক্রান্ত রোগে ভুগছেন তিনি। তবে লিভারজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণটা কী ছিল, সে বিষয়ে তখনও জানতে পারেননি। চিকিৎসকরা শুধু জানিয়েছিলেন লিভারের সমস্যা।
গবেষণাকাজে চিকিৎসকদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষকদের। অসুস্থ আজমার বিষয়টি গবেষকদের জানান চিকিৎসক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ‘পরিবেশ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান’ গবেষণাগারে আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিষয়ে এক দশক ধরে গবেষণা হচ্ছে। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে রোগ সৃষ্টিতে আর্সেনিকের প্রভাব ও দেশে আর্সেনিকের ভয়াবহতাসহ নানা তথ্য।
২০০৭ সালের শেষের দিকে বিভাগের তরুণ গবেষক অধ্যাপক ড. খালেদ হোসেনের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে গবেষণাগারটি। এই গবেষণাগারের প্রধান ইনভেস্টিগেটর তিনি।
আজমার বিষয়টি জানার পর গবেষণাগার-প্রধান অধ্যাপক ড. খালেদ হোসেনসহ গবেষকরা আজমার বাড়িতে গিয়ে তার শরীর ও খাদ্যসামগ্রী থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন। নমুনাগুলো পরীক্ষা করে গবেষকরা জানান, তার লিভার সমস্যার অন্যতম কারণ আর্সেনিক। খাদ্যসামগ্রী পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু পরামর্শও দেন তাকে। সেই থেকে গবেষকদলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন আজমা। চিকিৎসকের প্রয়োজন পড়লেই ওই গবেষকদের কাছে পরামর্শ নিতে ছুটে আসেন।
গবেষণাগারের গবেষক ও গবেষণা সমন্বয়কারী চিকিৎসকরা সাধ্যমতো জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও প্রয়োজনে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গবেষকদল চেষ্টা করেন, আর্সেনিক আক্রান্তদের সাধ্যমতো সেবা দিতে।
গবেষকদলের একজন আবু ইব্রাহিম সিদ্দিকী সিয়াম জানান, গবেষণার কাজে যাদের কাছে গিয়েছি তাদের থেকে প্রায়ই একজন না একজন লোক আমাদের এখানে আসেন। তাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে গাড়িতে ওঠানো পর্যন্ত কাজ করেন বন্ধুরা। এ কাজে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
জানা গেল, শুধু আজমা খাতুন নয়, দেশের পাঁচটি জেলার পুরুষ-নারী মিলে প্রায় হাজারখানেক লোক এই গবেষণাগারের গবেষকদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক পরমর্শ নিচ্ছেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছেন গবেষকদের কাছে।
বর্তমানে গবেষণাগারের প্রধান ইনভেস্টিগেটরসহ গবেষক অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম সাউদ, দু’জন চিকিৎসক, চারজন পিএইচডি গবেষক ও গবেষণাকাজে সাহায্যকারী শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। তাদের সঙ্গে প্রতিদিন প্রায় ১৫ শিক্ষার্থী স্বেচ্ছায় রোগীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা-বিষয়ক সেবা ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে চলেছেন। এক দশক ধরে গবেষণার পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে সেবামূলক এই কাজ। প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার কাজও করেন তারা।
গবেষণাগারের শুরুটা এমন ছিল না। মানুষকে স্বাস্থ্যসচেতন করার উদ্দেশ্যেও এর যাত্রা হয়নি বলে জানান প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. খালেদ হোসেন। তিনি বলেন, গবেষণা প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে অসুস্থ মানুষগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বেড়েছে।
আর্সেনিকবিষয়ক তথ্য
সম্প্রতি আর্সেনিক প্রতিরোধে যুগান্তকারী প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে হলুদ। এ বিষয়ে সফলতা পেয়েছে গবেষকদল। হলুদ শরীরের আর্সেনিকের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিক প্রতিরোধে ভ‚মিকা রাখতে হলুদগুলো অবশ্যই আর্সেনিক-কবলিত এলাকার বাইরের হতে হবে।
কারণ জানতে চাইলে গবেষকরা জানিয়েছেন, আর্সেনিক-কবলিত এলাকার শুধু পানি নয়, সেই এলাকার মাটিতে উৎপাদিত সব খাদ্যজাত সামগ্রী আর্সেনিক-কবলিত হয়ে যায়। এসব খাবার খাওয়ার ফলে অজান্তে দেহের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর্সেনিক।
গবেষণায় নীতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে প্রাথমিক গবেষণা ইঁদুরের ওপর করা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকদল। তবে মানুষের ওপর করা হলেও একই ফল পাওয়া যাবে বলে জানান অধ্যাপক খালেদ হোসেন।
স্বীকৃতি
এ গবেষণাগারের অনেক গবেষণা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন অধ্যাপক খালেদ হোসেন।
আর্সেনিক নিয়ে কাজের সুযোগে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন কয়েকজন গবেষক। গবেষণাগার সূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে প্রায় বিশজন গবেষক উন্নত গবেষণার জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। তাদের একজন এসএম নাদিম মাহমুদ এখন জাপানে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছেন।
সীমাবদ্ধতা
প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাঁটি-হাঁটি করে এগিয়ে যাওয়া ‘পরিবেশ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান’ গবেষণাগারের সাফল্যের খাতা বেশ ভারী হলেও রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগের সহায়তার পাশাপাশি গবেষকরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কারিগরি সহায়তার সব উপকরণ না থাকায় অনেক সময় গবেষণার কাজে ধীর গতি দেখা দেওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন গবেষকরা। তবু অনেক সমস্যার মধ্যেও সম্ভাবনা খুঁজছেন গবেষকরা। একাগ্রতা ও নতুন জ্ঞান উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানবসেবার এমন কাজ চালিয়ে যাওয়াই তাদের চালিকাশক্তি।
চন্দ্রবিন্দু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়