ইসমাইল আলী: শুরু থেকে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের। সুন্দরবনের সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কায় এ প্রকল্পটি নিয়ে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ছাড়াও দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ হয়েছে। তবে সবকিছু উপেক্ষা করেই বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণ করা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। ২০২২ ডিসেম্বরে এর প্রথম ইউনিটটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরুর পর থেকে নানামুখী জটিলতার সম্মুখীন হয়। ২০২৩ সালের নভেম্বরে এর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। এতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ করপোরেশনের (এনটিপিসি) ৫০ শতাংশ করে শেয়ার রয়েছে। তবে বাংলাদেশে নির্মিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ভারতীয়দের দাপট বেশি। তাদের কর্তৃত্ববাদে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে আছেন পিডিবির কর্মকর্তারা।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ঠিকাদারি কোম্পানি ছিল ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল)। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে আসার পর ১২ মাসে যান্ত্রিক ত্রুটিতে বন্ধ হয় সাতবার। এছাড়া পূর্ণ ক্ষমতায় চলে খুব কম সময়। এমন পরিস্থিতিতে এক হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাচালিত এই কেন্দ্রের যন্ত্রপাতির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে কঠিন শর্তে ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। আর এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা করে ইক্যুইটি বিনিয়োগ করেছে পিডিবি ও এনটিপিসি। এই ইক্যুইটি বিনিয়োগের ওপর ১৮ শতাংশ হারে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আরওআই) নিচ্ছে বিআইএফপিসিএল। যদিও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আরওআই নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ শতাংশ। ২০১২ সালে কোম্পানি গঠনের পর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চার বছরের মধ্যে নির্মাণের কথা ছিল। যদিও তা নির্মাণ করতে লেগেছে প্রায় আট বছর। পুরো নির্মাণেকালেই ১৮ শতাংশ হারে আরওআই নিয়েছে কোম্পানিটি। মূল বিনিয়োগের সঙ্গে তা যোগ করে ইক্যুইটির পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে গেছে।
এর বাইরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়োজিত পিডিবি ও এনটিপিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সূত্র জানায়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে এনটিপিসির ৫৫ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী রয়েছেন। এর মধ্যে প্রধান প্রকৌশলীসহ বেশকিছু শীর্ষ পদ ভারতীয়দের দখলে।
এছাড়া রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিভিন্ন পর্যায়ে ১৪ প্রধান প্রকৌশলী নিয়োজিত রয়েছেন। যদিও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রধান প্রকৌশলী মাত্র একজন। এদিকে রামপালে কর্মরত ভারতের প্রকৌশলীদের বেতন-ভাতা অনেক বেশি ধরা হয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত ৫৫ ভারতীয় নাগরিক এনটিপিসির স্কেলে বেতন-ভাতা পান। আর পিডিবির কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত স্কেলে বেতন পান। এনটিপিসির বেতন-স্কেল পিডিবির দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া ভারতীয়দের বেতন দেয়া হয় ডলারে। তবে পিডিবির কর্মকর্তারা বেতন পান দেশীয় মুদ্রা তথা টাকায়।
এর বাইরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত ভারতের প্রকৌশলীদের বাংলাদেশে আবাসন থেকে বাবুর্চি সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে প্রকল্প এলাকায়। এরপরও তাদের দৈনিক ভাতা (ডিএ) হিসেবে মাসে সাড়ে তিন হাজার ডলার দেয়া হয়, যা পিডিবির কর্মকর্তাদের দেয়া হয় না। এতে ভারতের কর্মকর্তারা পিডিবির কর্মকর্তাদের চেয়ে প্রায় চার থেকে পাঁচগুণ বেতন-ভাতা পান। অন্যদিকে, পায়রার তুলনায় দক্ষতা কম হলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ তুলনামূলক বেশি। পিডিবির এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট। পূর্ণ সক্ষমতায় এ কেন্দ্রটিতে উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ৭৭ কোটি ১৯ লাখ দুই হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে মাসে তিন কোটি ২৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে চার দশমিক ২১ সেন্ট।
অন্যদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ৭৬ কোটি ৫৬ লাখ ৯৭ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে মাসে তিন কোটি ৭১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে চার দশমিক ৮৫ সেন্ট। অর্থাৎ রামপালের ক্যাপাসিটি চার্জ ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি।
সূত্রমতে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার পর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়েছে সাতবার। তবে এর পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার পর সক্ষমতার চেয়ে সবসময়ই কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে রামপালের দুটি ইউনিট। প্রতিটি ইউনিটের সর্বোচ্চ সক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট হলেও দৈনিক গড়ে ৫৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ওই কেন্দ্রের একটি সূত্র জানায়, ৬০০ মেগাওয়াট লোডে দীর্ঘ সময় উৎপাদনে থাকলে প্রথম ইউনিটটির বয়লারের টিউব লিকেজ হচ্ছে। ফলে প্রথম ইউনিটটি ঠিকমতো লোড নিতে পারে না।
যেসব যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো টারবাইনে সমস্যা, বয়লার টিউব লিকেজ, কুলিং হিটারে লিকেজ, হাইপ্রেশার স্টিম লিকেজ, অয়েল লিকেজ ও গ্ল্যান্ডফিল লিকেজ। পিডিবির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রেই শুরুতে নানা জটিলতা থাকে। ধীরে ধীরে ত্রুটি সারিয়ে সেগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চলতে পারে। তবে বয়লার ও টারবাইনে সমস্যা হলে তা বড় ধরনের কারিগরি দুর্বলতা। এ সমস্যা বারবার হলে চিন্তার কারণ আছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক প্রকৌশলী বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের জুনে। কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কারিগরি ত্রুটির কারণে একদিনও বন্ধ থাকেনি। যদিও রামপাল বারবার বন্ধ হয়েছে কারিগরি ত্রুটিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যারা পরিদর্শন করেছেন, তারাই বলেছেন সবকিছু বিবেচনায় রামপাল আর পায়রার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। রামপাল যারা নির্মাণ করছে, তারা কেন গুণগত মান ঠিক করল না, সেটা দেখার বিষয়। না হলে পুরো বিষয় ভেস্তে যাবে, যা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি। কারণ নির্ধারিত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারলে জরিমানা করা হয়। রামপালের ক্ষেত্রে এটা হলে সেই জরিমানার অংশ পিডিবিকে বহন করতে হবে।