Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 8:42 pm

রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে ফোর্সড লোন ৯,২২২ কোটি টাকার

জয়নাল আবেদিন: রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় ফোর্সড লোন বাড়ছে। আর এসব লোন সৃষ্টিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ম মানা হচ্ছে না, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকে ফোর্সড লোন সৃষ্টির ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত সব পর্যায়ের কর্মকর্তার জবাবদিহি নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

তথ্য অনুযায়ী, সরকারি খাতের চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে জুন পর্যন্ত ফোর্সড লোনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুনÑএ ৬ মাসে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে ফোর্সড লোন বেড়েছে ৩০৯ কোটি। তবে রূপালী ব্যাংকে কমেছে ৭৫ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, আমদানি দায় সময়মতো পরিশোধে ব্যর্থ গ্রাহকের নামে ব্যাংক যে ঋণ সৃষ্টি করে তাকে ফোর্সড লোন বলা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের ফোর্সড লোনের পরিমাণ ২ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে ছিল ২ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ৬ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির ফোর্সড লোন বেড়েছে ৬ কোটি টাকা। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অগ্রণী ব্যাংকের ফোর্সড লোন। ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির ফোর্সড লোন বেড়েছে ২৬৭ কোটি। অন্যদিকে জনতা ব্যাংকের বেড়েছে ৩৬ কোটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুনÑএ ৬ মাসে একমাত্র রূপালী ব্যাংকের ফোর্সড লোনের পরিমাণ কমেছে। তারা ফোর্সড লোন থেকে আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে ঋণের পরিমাণ কমে এসেছে। বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের ফোর্সড লোন রয়েছে ৯১৫ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে ছিল ৯৯০ কোটি টাকা। সে হিসাবে ৬ মাসে ব্যাংকটির ফোর্সড লোন কমেছে ৭৫ কোটি টাকা।

উল্লেখ, পণ্য আমদানির (ঋণপত্র বা এলসি) বিপরীতে বিদেশি ব্যাংককে গ্যারান্টি দিয়ে থাকে দেশি ব্যাংক। দেশে আমদানি পণ্য আসার পর শর্ত অনুযায়ী গ্রাহক ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করলে ওই অর্থ বিদেশি ব্যাংককে দেশি ব্যাংক পরিশোধ করে দেয়। এক্ষেত্রে গ্রাহক কোনো কারণে অর্থ পরিশোধ না করলে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী গ্রাহকের নামে ব্যাংক ফোর্সড বা বাধ্যতামূলকভাবে সমপরিমাণ ঋণ সৃষ্টি করে। ওই অর্থে ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকের দেনা শোধ করে। এভাবে ব্যাংক গ্রাহকের নামে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে। মূলত আমদানির বিপরীতেই এসব ফোর্স লোন সৃষ্টি হয়েছে।

অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ ঋণ ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। বড় গ্রুপগুলোকে ঋণ দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তারা। কারণ ক্ষুদ্র বা মাঝারি ঋণে পরিচালন ব্যয় ও পরিশ্রম দুটোই বেশি। তাই করপোরেট গ্রাহকদের কাছে ঋণ দিতে চায় ব্যাংকগুলো। কিন্তু সমস্যা হলো, এর মাধ্যমে বড় গ্রাহকগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক ও অর্থনীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে মোট ৬৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে জনতা ব্যাংক। এর মধ্যে ৪৫ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে মাত্র পাঁচটি শাখা থেকে, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৭২ শতাংশ। শুধু জনতাই নয়, পাঁচ শাখার মাধ্যমে অধিকাংশ ঋণ বিতরণ করা ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে আরও তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন শেষে ৩৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে মাত্র পাঁচ শাখার মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে ২১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের ৬১ শতাংশই বিতরণ হয়েছে মাত্র পাঁচটি শাখার মাধ্যমে। এছাড়া পাঁচ শাখার মাধ্যমেই ৪৭ শতাংশ ঋণ ছাড় করা হয়েছে অগ্রণী ব্যাংকেও। মোট ৫৪ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে পাঁচ শাখার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।

এদিকে জুন পর্যন্ত ৬০ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে সোনালী ব্যাংক, যা সোনালী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ৩১ শতাংশ। ওই পাঁচ শাখার মাধ্যমে ব্যাংকটির বিতরণ হয়েছে ১৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এ ব্যাংকের মোট শাখা সংখ্যা এক হাজার ২২৮টি।

জানতে চাই অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম শেয়ার বিজকে জানান, করোনার মধ্যে ফোর্স লোন আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল। কারণ অনেক রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে। তাই সৃষ্টি হয়েছে কিছু ফোর্স লোন। এটা খুব বেশিদিন থাকবে না। এখন আবার রপ্তানি শুরু হয়েছে। এখন গ্রাহকের প্রয়োজনেই ঋণগুলো এডজাস্ট করবে। সুতরাং খুব শিগগিরই ফোর্স লোন কমে আসবে বলে আশা ব্যক্ত করেন এমডি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ফোর্সড লোন ব্যাংকের জন্য মোটেও ভালো নয়। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে এসব ঋণ সৃষ্টি করা হয়। ব্যাংকের স্বার্থে টাকাগুলো বের হওয়ার আগে থেকে সবাইকে সচেতন থাকা উচিত। তবে যেসব ফোর্স লোন তৈরি হয়ে গেছে, তা আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের।