নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। ঋণ ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়মের কারণে অধিক খেলাপি ও প্রভিশন রাখতে গিয়ে মূলধন সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন সহায়তার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসেছে সরকার।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেন, জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় ক্যাপিটাল ইঞ্জেকশনের (মূলধন সহায়তা) মতো প্রথা দীর্ঘদিন দেশে প্রচলিত ছিল।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করছি যেন তারা নিজেদের ব্যবসায় মডেল নতুন করে সাজিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ক্রমেই আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবের সময় বলেন, ‘কভিডকালে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় মুনাফা অর্জিত না হলেও তাদের অর্থ জোগান দিতে হয়নি। ব্যাংক খাত থেকে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে করপোরেট কর আদায় হয়েছে প্রায় আট হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া আর্থিক ক্ষেত্রে যেসব আইনি সংস্কারের উদ্যোগের কথা আমি বলেছি, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে ব্যাংক খাতের ভিত্তি আরও মজবুত ও সুদৃঢ় হবে।’
ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি কমে এসেছে। কারণ তারা সরকারের পক্ষ থেকে মূলধন সহায়তার সুবিধা চেয়ে না পাওয়ায় প্রফিটের টাকা ডিভিডেন্ট না দিয়ে মূলধন সংরক্ষণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৭ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা। তিন মাস আগেও এর পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৪৭৩ কোটি। সুতরাং তিন মাসের ব্যবধানে আট হাজার ১৩৪ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি কমেছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত পদক্ষেপের রূপরেখা নেই: সিপিডি
২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর গতকাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটে মূল্যস্ফীতিজনিত সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করা হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এবারের বাজেটে ছয়টি মূল চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়ত, সার, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি-সংক্রান্ত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান করা। তৃতীয়ত, বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয় বিভাগের উচ্চ অধিকারসম্পন্ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা। চতুর্থত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করা। পঞ্চমত, অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয় করদাতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। ষষ্ঠত, টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক রাখা। এখন এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বাজেটে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেদিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে বাজেটে বহুবার মূল্যস্ফীতির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ে নেয়া পদক্ষেপ একেবারে পর্যাপ্ত নয়।
তিনি বলেন, কর কাঠামোর বিষয়ে কিছুদিন আগে আমাদের বাজেট প্রস্তাবনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর কর উঠিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলাম। কিছু কিছু পণ্যে ওঠানো হয়েছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। কারণ তার বাইরেও আরও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভোগ করতে হয়। এই বাজেটে গম ছাড়া আর কোনো পণ্য দেখা যাচ্ছে না। আমরা বলেছিলাম চাল, চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের কর ছাড় দেয়া।
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি খাতে ন্যূনতম করমুক্ত সীমা আমরা সাড়ে তিন লাখ টাকা করতে বলেছিলাম। কিন্তু সেটা তিন লাখই রয়েছে। অথচ যারা এর চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে, তাদের সুবিধার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমন বেতনের বাইরে বিভিন্ন ধরনের অ্যালাউন্স, সুযোগ-সুবিধা, যাতায়াত, বাড়িভাড়া, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যে করমুক্ত সীমা, সেটা সাড়ে পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। এটা তো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য করা হয়নি।
তারপরে কৃষিতে ভর্তুকি রাখা হলেও গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য রাখা হয়নি। অর্থমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। মানে দর বাড়ানো হবে, কিন্তু এই সময়ে এটা বাড়ালে জনগণের ব্যয়ের ওপর চাপ পড়বে। মূল্যস্ফীতিকে মাথায় রেখে সামাজিক সুরক্ষার পরিসর ও পরিমাণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গতবারের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে কমানো হয়েছে, যা একেবারে কাম্য নয়।
বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা নেই এবং মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা জানি, বেশিরভাগ প্রকল্প পিছিয়ে রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে পিছিয়ে যাওয়া মানেই সেখানে ব্যয় বেড়ে যাওয়া। এছাড়া এই বাজেটে সর্বজনীন পেনশনের কথা বলা হলেও কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে, সেটার কোনো নির্দেশনা কিংবা সুস্পষ্ট কোনো কিছু বলা হয়নি।
তারপর কর আহরণের ক্ষেত্রে নতুন কোনো উদ্যোগ দেখছি না, বরং দেখা গেছে নিন্ম আয়ের জনগণের চেয়ে উচ্চ আয়ের জনগণের জন্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। আবার বিদেশ থেকে টাকা আনার ক্ষেত্রে করছাড় দেয়া হয়েছে, যেটা একেবারে অনৈতিক। এটা সামাজিক ন্যায় বিচারের দিক থেকেও গ্রহণযোগ্য নয়। আমদানি ব্যয় কমাতে আমদানির বিকল্প শিল্পকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, এটা প্রশসংনীয়।
টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে আনার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আমরা সেখানে পরিষ্কার কোনো পদক্ষেপ বা নির্দেশিকা দেখছি না।
সামগ্রিক বিচারে বলতে চাই, যে লক্ষ্যে এই বাজেট তৈরি হয়েছে, সেই লক্ষ্যগুলো হয়তো ঠিক। কিন্তু সেই লক্ষ্যগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এই বাজেটে যে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তা অপরিপূর্ণ। নীতি-কৌশলের পথনির্দেশক প্রণয়নের ক্ষেত্রে সেটা অসম্পূর্ণ এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকবিলায় অপর্যাপ্ত।
প্রস্তাবিত বাজেট উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী: এফবিসিসিআই
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটকে উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী বলে দাবি করে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। গতকাল এফবিসিসিআইয়ের বোর্ড রুমে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট নিয়ে পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি।
এ সময় এফবিসিসিআই সভাপতি জানান, ব্যক্তিগতভাবে তিনি কালোটাকা সাদা করা পছন্দ করেন না, কারণ এতে সৎভাবে যারা ব্যবসা করছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হবেন। তারা নিরুৎসাহিত হবেন বলেও তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব সরকার, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সাধারণ মানুষের উপকারের জন্যও অনেক প্যাকেজ এনেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ সালের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ‘কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামের এবারের বাজেটটি প্রস্তুত হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন ও উদ্ভ‚ত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়ে।
দিকনির্দেশনা নেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়: সানেম
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জগুলোকে স্বীকার করা হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। তবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ জরুরি, সেখানে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাব বিদ্যমান। বিশেষত, মূল্যস্ফীতি-সংক্রান্ত যে সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তা সমাধানের লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির শুল্ক কমানো এবং জোগান বৃদ্ধি করার জন্য প্রথাগত আমদানির বিকল্প উৎস খতিয়ে দেখার মতো বিভিন্ন উদ্যোগ বাজেট ঘোষণায় অনুপস্থিত ছিল। বাজেটে যদিও মূল্যস্ফীতির সমাধানে মজুতদারির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে; তবে বাজার ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব দেশে অনেকদিন ধরেই বিরাজমান।
বাজেটে বেশকিছু প্রশংসনীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে উল্লিখিত আছে, যেগুলো আমরা বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বা অন্যান্য সরকারি পরিকল্পনায়ও দেখেছি, কিন্তু তার বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনার অভাব যথারীতি এই বাজেটেও বিরাজমান। যেমনÑশিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বৃদ্ধি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা কারিগরি শিক্ষাসংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে, বাস্তবায়নের রূপরেখার অভাব বাজেটে পরিলক্ষিত হয়েছে। পাশাপাশি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে এবং অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়নে যে সক্ষমতার অভাব বিদ্যমান, তার সমাধানকল্পে দিকনির্দেশনার অভাব বাজেটে পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষত, শিক্ষার ক্ষেত্রে, অতিমারি-পরবর্তী শিখন ক্ষতি মোকাবিলায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। সম্পূরক বাজেটের পর্যালোচনায় প্রতীয়মান যে, বাজেট বাস্তবায়নের জায়গায় যে সক্ষমতার অভাব আমাদের দীর্ঘকালীন একটি সমস্যা, সেখানে আমরা এখনও আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি।
বিনিয়োগ-সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো, যেমন পিপিপি-সংক্রান্ত আলোচনা, প্রভৃতি বাজেটে যথাযথভাবে উঠে আসেনি, বরং গতানুগতিকভাবে বিবৃত হয়েছে।
বাজেটে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বিবৃত পদক্ষেপগুলোর অধিকাংশই বাস্তবে প্রশ্নসাপেক্ষ অবস্থায় রয়েছে, যেমন টিসিবির মাধ্যমে বা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছানোর যে উদ্যোগ, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলেই মনে হয়েছে। এ উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো বিদ্যমান, তার আলোচনার অভাব রয়েছে বাজেট ডকুমেন্টে। একদিকে চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমানোর পদক্ষেপ-সংক্রান্ত বক্তব্য স্পষ্ট নয়। কারণ প্রথমত, বর্তমান মূল্যস্ফীতি-সংক্রান্ত সংকটের কারণ চাহিদা বৃদ্ধিজনিত নয় বরং জোগানের সরবরাহের সংকট; দ্বিতীয়ত, এ ধরনের পদক্ষেপ অর্থনীতিকে সংকুচিত করবে, যা অতিমারি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে বাধার সৃষ্টি করবে। আগামী বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশ রাখার কথা বলা হয়েছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয়েছে।
অতিমারি থেকে পুনরুদ্ধারের যে দাবি বাজেটে করা হয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশেষত, সামাজিক পুনরুদ্ধারের গতি দুর্বল, যা বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। এমনকি দারিদ্র্য হারেরও হাল-নাগাদকৃত তথ্যের অভাব বিদ্যমান রয়েছে বাজেটে। পাশাপাশি, বর্তমান প্রেক্ষাপট অতিমারি থেকে পুনরুদ্ধারকে কীভাবে প্রভাবিত করছে সেই সংক্রান্ত আলোচনার অভাব বাজেটে লক্ষণীয়। বাজেটে উল্লিখিত ছয়টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়ের তালিকায় দারিদ্র্য এবং কর্মসংস্থান-সংক্রান্ত আলোচনার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
বাজেট ঘোষণায় জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৫ বাস্তবায়ন করার বলা হলেও, এখনও এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একটি সম্পূর্ণ তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে যে অসামাঞ্জস্য রয়েছে, প্রকৃত গ্রহীতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা রয়েছে, তা কীভাবে দূর করা হবে বাজেট ঘোষণায় তা অনুপস্থিত ছিল।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা বলা হলেও গতানুগতিকতার বাইরে বড় ধরনের কোনো সংস্কারের কথা বাজেট ঘোষণায় পরিলক্ষিত হয়নি। আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যে সংস্কারগুলোর প্রয়োজন ছিল, তাও প্রস্তাবিত বাজেটে পাওয়া যায়নি।
সুদের হার যৌক্তিকীকরণের কথা বলা হলেও ব্যাংক খাতে সুদের হারের নয়-ছয় শতাংশের যে নির্ধারিত সীমা রয়েছে, তার ফলে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের বেশি হলে আমানতের প্রকৃত সুদের হার যে ঋণাত্মক হতে পারে, সে বিষয়ে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা চোখে পড়েনি।
বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কর ছাড় দেয়ার যে প্রবণতা, বাজেট ঘোষণায় তা পরিহার করার কথা বলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য বাড়ানোর জন্য পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও যে সুবিধা দেয়া কথা বলা হয়েছে, সেটি সময়োপযোগী।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ: ডিসিসিআই
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিই প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নে মূল চ্যালেঞ্জ হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিসিসিআই এ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
ঢাকা চেম্বার জানিয়েছে, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাজস্ব ঘাটতি ও অর্থায়ন প্রভৃতি বিষয়গুলো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। প্রাক্বলিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে করজাল পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করা, করকাঠমোর অটোমেশন, যৌক্তিক রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও সরকারি ব্যয়ে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বাজেটে আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত বাজেটে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি স্থানীয় ব্যাংকিং ও অন্যান্য বৈদেশিক খাত থেকে অর্থ সংস্থানের নির্ভরতা তৈরি করতে পারে। ঢাকা চেম্বার মনে করে, বাজেটের আকার বাড়ানোর চাইতে পরিকল্পিত, সময়োপযোগী, ব্যয় কার্যক্রমে দক্ষতা অর্জন এবং বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রণয়ন একান্ত অপরিহার্য।
করপোরেট কর হ্রাসের ক্ষেত্রে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১০ শতাংশের বেশি আইপিওর মাধ্যমে বাজারে ছাড়া এবং লিস্টেড ও নন-লিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রে বার্ষিক মোট ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ ব্যয় ও বিনিয়োগ ছাড়া সব ধরনের লেনদেন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সম্পন্ন না করলে লিস্টেড কোম্পানির ২৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও বেশি হারে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য পর্যায়ক্রমে বিদ্যমান করপোরেট কর হ্রাস করা প্রয়োজন বলে মনে করে ঢাকা চেম্বার।
বেসরকারি বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রাখতে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর নতুন করে করের বোঝা আরও না বাড়িয়ে, করজাল বৃদ্ধির জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে অন্যান্য জেলাগুলোয় আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর জোরারোপ করা প্রয়োজন। ব্যক্তি শ্রেণির আয়করে ন্যূনতম সীমা অপরিবর্তিত না রেখে তা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
পণ্য জব্দ করার ক্ষমতা ধারা ৮৩, ৮৪ এবং ১০০ ধারাগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন, যাতে করে হয়রানিমুক্ত ভ্যাট ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায়। প্রস্তাবিত বাজেটে পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল সাপ্লাইয়ে উৎসে কর ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়, তবে উৎসে করের হার সব রপ্তানিকারকের জন্য সমানভাবে নির্ধারণ করা একান্ত আবশ্যক, এর ফলে তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতের বৈষম্য হ্রাস পাবে।
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ও পরিচালন ব্যয় দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে, এ পরিস্থিতিতে রাজস্ব সংগ্রহ কাক্সিক্ষত হারে বৃদ্ধি না পেলে সরকারের ব্যাংক নির্ভরতা আর্থিক খাতকে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে। এমন বাস্তবতায় আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ব্যাংক ঋণ ও অন্যান্য খাতে যেমন: সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ এবং সুদের হারের মধ্যে ভারসাম্য রাখার আহŸান জানাচ্ছে ডিসিসিআই।
বাজেটে বেসরকারি খাত থেকে ২৪.৯ শতাংশ বিনিয়োগ প্রাপ্তির প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নের গতি আশাব্যঞ্জক নয়, উল্লেখ্য মে ২০২২ পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার ৫৮.৩৬ শতাংশ। এছাড়া বৃহৎ প্রকল্পগুলো স্বল্প সময় ও খরচের দ্রæত বাস্তবায়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে বাধা তৈরির পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা আরও বাড়বে।
চলতি অর্থবছরে ৪৭.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানির বিপরীতে আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৮.৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এতে মোট বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২১.৭ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বৈচিত্র্যকরণ ও রেমিট্যান্স আহরণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে, বাজেটে বিশেষ নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।