Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 5:46 pm

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফের উদ্বেগ

রোহান রাজিব: এবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এছাড়া ঋণ পুনঃতফসিল নিয়ে নতুন সার্কুলার ও ডলারের অভিন্ন রেটের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব ব্যাংকের খেলাপির বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা জানতে চায়। এছাড়া কোনো শাস্তি দেয়া হয় কি না, এ বিষয়েও জানতে চায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্থাটিকে  বলেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে সরকার জড়িত থাকার কারণে এখানে কিছু বিষয় সরকারের ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করে। তাই অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারে না।

জানা যায়, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাযথ নিয়মে প্রভিশন রাখা নিয়ে আইএমএফ প্রশ্ন তুলেছে। তারা এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যা ভবিষ্যতে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয় সংস্থাটিকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকায়। এটি এ খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ১০ হাজার ৫৫৭ কোটি, বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের ৭৬৭ কোটি, বেসিক ব্যাংকের আট হাজার ২৪৯ কোটি, জনতার ১৭ হাজার ২৬৩ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ছয় হাজার ৪৬৫ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকের ১২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা খেলাপি রয়েছে।

জানা যায়, গতকাল প্রথম অধিবেশনে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সঙ্গে আলোচনায় বসে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এতে এএমএল/সিএফটি ঝুঁকিভিত্তিক তত্ত্বাবধান ও অন্যান্য প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা হয়। এরপর ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ ও ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের পরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এতে আর্থিক খাতের ডেটা-সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় সংস্থাটি। এছাড়া পরিসংখ্যান বিভাগের বিওপি-সম্পর্কিত প্রযুক্তিগত বিষয় জানতে চায় সংস্থাটি।

তৃতীয় অধিবেশনে গবেষণা বিভাগ, মনিটারি পলিসি ডিপার্টমেন্ট, চিফ ইকোনমিস্টস ইউনিট, ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এবং সচিব বিভাগ ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে রয়েছেÑপ্রত্যাশিত মুদ্রাস্ফীতির উন্নয়ন এবং এমপির অবস্থানের বর্তমান মূল্যায়ন, দ্বিতীয় দফায় জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব; যেকোনো প্রত্যক্ষ মূল্য নিয়ন্ত্রণ পরিমাপ, মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা সমীক্ষার ফলাফল, বিনিময় হারের চাপ এবং প্রত্যাশিত উন্নয়ন। এছাড়া রয়েছে সুদের হার করিডোর সিস্টেম বাস্তবায়নে বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সময়সীমা, প্রতি বছরে দুই এমপিএস ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানোর বর্তমান অবস্থা, আইআর নীতি বাস্তবায়নে অগ্রগতি এবং সামনের চ্যালেঞ্জ, প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন এবং সুশাসনকে শক্তিশালী করার জন্য ২০২২ আইএমএফের সেফগার্ডস অ্যাসেসমেন্টের সুপারিশের পরিচালননীতি।

এছাড়া ব্যাংক টু ব্যাংক পর্যালোচনা এবং সেক্টরভিত্তিক আর্থিক সূচকগুলোর ওপর আপডেট (২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত) এফএসআই সংগ্রহ, সংকলন ও প্রকাশ করার পরিকল্পনা, সাম্প্রতিক আইএমএফ সম্মেলনের প্রতিফলন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপ ও অন সাইট এবং অফ-সাইটের কার্যক্রম ও ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যাংকের তত্ত্বাবধান আপডেট বিষয়ে ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্ট ও অফসাইট সুপারভিশন ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।

অপরদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক-এসওসিবি’র অধীন এমওইউ’র সংস্কার ও কর্মক্ষমতার অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক, সহযোগী প্রতিষ্ঠান, ইক্যুইটি বাজার-সাম্প্রতিক ক্রিয়াকলাপ এবং ঝুঁকিবিষয়ক আপডেট, ১০টি ব্যাংকের সঙ্গে পাইলট প্রকল্পের অবস্থা, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির উন্নতি ও ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য সংস্কার, অগ্রাধিকারভিত্তিক পাঁচটি প্রধান আইন চূড়ান্তকরণের অবস্থা এবং সংসদীয় অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চায় প্রতিনিধিদল। ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

জানা যায়, বৈঠকে এক্সচেঞ্জ রেটের অভিন্ন রেট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে একাধিক রেট থেকে সরে আসার পরামর্শ দেয়। একটি একক রেটে বাজার চালাতে বলে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, আইএমএফকে একচেঞ্জ রেট নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ যে করছে, সে বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে একটা ক্লোজার রেটে চলে আসবে বলে জানানো হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে হঠাৎ এ রেট থেকে সরে আসা যাবে না। তাই এ মুহূর্তে একক ইউনিফর্ম রেট ঘোষণা করা যাচ্ছে না।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত মোট ছয়টি সেশনে বিভিন্ন বিষয়ে বৈঠক করে সফররত আইএমএফ মিশন। বৈঠকে আইএমএফ মিশন বলেছে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুদহার বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত। এছাড়া ঋণের সুদহার এত কম রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। চাহিদা ব্যবস্থাপনার জন্য সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, সুদের হার সীমা বেঁধে দেয়ায় বিনিয়োগসহ অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহারকে একটি লক্ষ্যভিত্তিক করার কথা বলেছে আইএমএফ। এছাড়া আগামীতে প্রতিবছর চারবার মুদ্রানীতি প্রকাশের লক্ষ্যে আপাতত বছরে দুবার ঘোষণা করতে বলা হয়েছে। আগে ছয় মাস অন্তর মুদ্রানীতির ভঙ্গি ঘোষণা করত বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির দায়িত্ব নেয়ার পর বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা শুরু করেন।

সূত্র জানায়, সুদহারের সীমাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলেও তিনটি সেশনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বাংলাদেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের হিসাব পদ্ধতি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের প্রক্ষেপণ, আমদানি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। একটি সেশনে আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসাব প্রকাশের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে কবে নাগাদ শুরু করা হবে, তা সিদ্ধান্ত হবে। আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণের পাশাপাশি শুরুতে বিদ্যমান পদ্ধতির হিসাবও প্রকাশ করা হবে। আইএমএফের বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ সাড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলারের কম। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ ছিল ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ শেয়ার বিজকে বলেন, আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। খেলাপি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে সংস্থাটির প্রতিনিধিরা জানতে চায়। তখন ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের ১৬ নম্বর প্রজ্ঞাপন উল্লেখ করে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়গুলো অবহিত করা হয়েছে।

খেলাপি ঋণের শাস্তি-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংক কোম্পানি আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে সরকার জড়িত থাকার কারণে এখানে সরকারের সিদ্ধান্ত একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। এখানে আইএমএফ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন নিয়ে কথা বলার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রনিনিধিদল তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জবাব দেয়। সংস্থাটি বেশকিছু পরামর্শ দেয়, বাংলাদেশ ব্যাংক যা আগামীতে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয়।

উল্লেখ্য, এর আগে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা এবং বাজেট সহায়তা হিসেবে আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে চায় সরকার। এ ঋণের বিষয়ে আলোচনা করতে ১৫ দিনের সফরে গত বুধবার ঢাকায় এসেছে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল। প্রথম দিন সংস্থাটির সঙ্গে বৈঠকে বসে অর্থ মন্ত্রণালয়।