প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেন। এ পদত্যাগ স্বাভাবিক তো থাকলই না, বরং জনরোষের অনিবার্য পরিণতি বরণ করতে হলো তাকে। আগে বিদেশ যেতে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে মন্ত্রী ও পদস্থ আমলাদের উপস্থিত থাকা একপ্রকার নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এবার তিনি কারও না জানিয়ে চুপিসারে সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়লেন। বিদেশে যেতে বিরাট বহর নিয়ে যেতেন। বহরে কয়েকজন অজ্ঞাতকুলশীল সংবাদিকও থাকতেন। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ কিংবা দেশত্যাগকে কোনোভাবেই সম্মানজনক বলা যাবে না।
এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গোটা দেশ দেখল মৃত্যুর মিছিল। প্রতিটি হত্যায় মানবিকতার পরাজয় ঘটে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হলো তা কারও অজানা নেই। শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক কীভাবে সাউন্ড গ্রেনেড, টিআর গ্যাস ছুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলছাড়া করা হলো, তা টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করার বদৌলতে দেশবাসী দেখেছেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ‘শান্তিপূর্ণভাবে হল ছাড়ায় শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ’ জানানোকে ভালো চোখে দেখেননি কেউ। শুধু তা-ই নয়, সরকারের অদূরদর্শিতায় হারিয়ে গেল শত শত প্রাণ। এর মধ্যে রয়েছে অন্তত ৪০ জন নিষ্পাপ শিশু! তবু এতটুকু অনুতাপ বোধ মনে জাগ্রত হয়নি কারও। বরং হুমকি ও আস্ফালন ছিলÑধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে কঠোর জবাব দেয়া হবে। কিন্তু এর মধ্যে জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।
তারপর কী হলো তা সবাই দেখেছেন। বিশ্লেষকরা বলেন, শক্তির উš§ত্ত প্রকাশ ছোটই করছে। কতটা ছোট করেছে; সেটি সামেনে এসেছে। শুধু সাফল্য, উন্নয়ন, বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি, অগ্রগ্রতিতে বুঁদ হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করা হয়েছে। অন্যায় কে প্রশ্রয় দিয়েছে। কত অর্থ পাচার হয়েছে, কত কাণ্ড ঘটেছে; সেটি নানাভাবে গণমাধ্যমে এসেছে। জনগণের কাছে জবাবদিহির দায় না থাকায় রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ‘মানি মেকার’ এবং ‘রুল মেকার’ যোগসাজশে একচেটিয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বন্দোবস্ত তৈরি হয় একদলীয় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের তিন বিভাগের (সংসদ, নির্বাহী ও বিচার) মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স না থাকায় ক্ষমতার পৃথক্?করণের অনুপস্থিতি দেখা গেল। সকল ক্ষমতা হয়ে গেল এক ব্যক্তিতে কেন্দ্রীভূত। রাষ্ট্র জনগণের ইচ্ছাধীন থাকল না।
বর্তমান কোটা সংস্কার আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীর মধ্যে থাকেনি; পরিণত হয়েছে গণআন্দোলন। আপামর জনতা ন্যায় দাবিতে মাঠে নেমেছে। প্রধানন্ত্রীর দেশত্যাগে সাধারণ মানুষ উল্লসিত। আনন্দের আতিশয্যে এমন কিছু ঘটছে, যা কাম্য নয়। গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ অন্যান্য ভবন থেকে সব সামগ্রী গণহারে নিয়ে গেছে সাধারণ মানুষ। ‘প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নয়’ আখ্যা দিয়ে যারা এসবের সমালোচনা করেছেন, তারাও বলেছেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার হওয়া বন্ধে সরকার আন্তরিক ছিল না। তাই বিভিন্ন সরকারি ভবন থেকে সম্পদ লুটে নেয়া নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করতে পারছি না। ক্রান্তিকালে দেশের সম্পদ রক্ষায়ই নাগরিকদেরই সচেতন হতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন কিংবা যে নামেই পরিচিত হোক না কেন; নতুন সরকার দেশের সম্পদ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেবে বলেই প্রত্যাশা।