Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 4:24 pm

জুলাই গণঅভ্যুত্থান, বিএনপি ও ইনক্লুসিভ পলিটিক্স

মো: নিজাম উদ্দিন:

এক.

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন- বিএনপি ডানপন্থীর বামে, বামপন্থীর ডানে। হ্যাঁ!এটাই বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান এটাই। বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক দল। কোনো ধর্ম এবং বিশ্বাসকেই বিএনপি রিজেক্ট করে না।সব ধর্মের মানুষ নিরাপদে ধর্ম পালনের অধিকারে বিশ্বাস করে বিএনপি। বিএনপি নাগরিকদের অধিকারকেই বেশি গুরুত্ব দেয়, ইজম নির্ভর পলিটিক্স থেকে। সে হিসেবে আপনি বিএনপিকে একটি রাইটস বেইজড পলিটিকাল পার্টি মনে করতে পারেন।বিএনপি মূলত এই কাজটাই এবং এই রাজনীতিটাই করতে চায়, যে কাজ এবং যে রাজনীতি একজন মানুষকে সমাজে নিরাপদে সম্মানের সাথে বসবাস করার সুযোগ তৈরি করে দিতে চায়।সমাজে রাজনৈতিক চিন্তার বৈচিত্র্য থাকা স্বাভাবিক। থাকা উচিতও। একটি মালায় শুধু এক ধরনের ফুল থাকলে যে সুন্দর দেখায় তার চেয়ে ফুলের বৈচিত্র্য মালার সৌন্দর্যও বাড়ায়। বাংলাদেশের সমাজ এবং রাষ্ট্রে চিন্তার বৈচিত্র্য আছে, এটা দৃশ্যমান। গণমুখী রাজনৈতিক দলের জন্য সব চিন্তার পজিটিভ জায়গায় আপনাকে বিরতি নিতে হবে, থামতে হবে। মানুষের কথা শুনতে হবে। বুঝতে হবে মানুষের মনের রাজনৈতিক ভাষা।এটা করতে সক্ষম না হলে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই গণমুখী দল হওয়া সম্ভব নয়,ক্ষমতার রাজনীতিও তাদের জন্য অস্বাভাবিক।

দুই.

বিএনপিকে নিয়ে হাজারটা অভিযোগ থাকতে পারে কিন্তু বিএনপি প্রতিষ্ঠার আগে জিয়াউর রহমান এদেশের মাটি ও মানুষের পার্লস্ বুঝতে পেরেছিলেন। এদেশে সব মানুষের দল হয়ে রাজনীতি করার মতো দল কম। সমাজের সব ভালো মানুষ,খারাপ মানুষ গুলোকে এভয়ড করে চললে সেই সমাজ টেকসই হয় কী করে, কীভাবে সেই রাজনীতি সার্বজনীন হয়।আপনি কাকে নেবেন আর কাকে নেবেন না এই দেয়াল তুলে ক্ষমতার রাজনীতিতে আপনি ঠিকতে পারবেন না।ইনক্লুসিভ চিন্তা না করলে আপনার দল এবং রাজনীতি দুটোই হারিয়ে যাবে। যেমনটা মুসলিম লীগের ক্ষেত্রে হয়েছে। বিএনপি রাজনীতির এই জায়গাটা ধরতে পেয়েছে। এদেশে যে রাজনীতি প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ইনসাফ ভিত্তিক রাজনীতি, অধিকার ভিত্তিক রাজনীতি, মানুষের কল্যাণ ভিত্তিক রাজনীতি। যার জন্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণাটা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। আপনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখুন। গ্রামের সাধারণ কৃষক ফজরের নামাজ পড়ে যুদ্ধে গেছে,শ্রমিক কারখানা বন্ধ রেখে, ছাত্র পড়াশোনা বন্ধ রেখে, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সবার রক্ত এক সাথে মিলিত হয়ে সেই রক্তের অক্ষরে লেখা হয়েছে আমাদের মুক্তি আর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।
আপনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে খেয়াল করে দেখুন। এখানে কী হলো?মায়েরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খাবার তুলে দিয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখে, যারা কোনো রাজনীতি করে না, করতেও চায়ও না। সুতরাং সার্বজনীন রাজনীতির বার্তা জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদেরকে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি সমাজে ইনসাফ কায়েম করার রাজনীতিটা করতে পারি তাহলে দেশ অটোমেটিকালি এগিয়ে যাবে।

তিন.

বিএনপি ইসলামকে কিভাবে দেখে? এই প্রশ্নও উঠছে। যেহেতু বিএনপি একটি উদারপন্থী রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে সুতরাং বিএনপি সব ধর্মকেই অত্যন্ত সম্মানের সাথে দেখে। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। বিএনপির ফোকাস মূলত রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট হচ্ছে সমাজে মানুষ মানুষ হিসাবে তার যে সম্মান মর্যাদা এটা পাবে, পেতে হবে। বিশেষ কোনো পরিচয়ের কারণে এই সম্মান কমবেও না, বাড়বেও না।সুতরাং ইসলাম কিংবা যেকোনো ধর্মকে বিএনপি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে।বিএনপি ইসলাম কিংবা ধর্ম বিদ্বেষী রাজনৈতিক দল এটা বলার ন্যুনতম সুযোগ নেই। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনীতিও ছিল সকল ধর্মকে রাষ্ট্র কর্তৃক যথাযথ সম্মানের রাজনীতি। ইসলামকে এদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে আজ যতটুকু সম্মান এবং শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয় তাতে জিয়াউর রহমান খুব একটা পজেটিভ ভূমিকা রেখেছেন।তিনি ব্যক্তিগত ভাবেও খুব প্রেক্টিসিং মুসলিম ছিলেন। সুতরাং বিএনপিকে ইসলামের মুখোমুখি দাঁড় করানোর সুযোগ কম।বিএনপি বাংলাদেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষের দল।এখানে ডান,বাম,উদারপন্থী, মধ্যমপন্থী সবাই আছে। একটা গণনভিত্তি সম্পন্ন রাজনৈতিক দলে শুধু এক চিন্তার মানুষ থাকে না, থাকে চিন্তা এবং মতবাদের বৈচিত্র্য,কিন্তু থাকে না বৈষম্য। জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে এক কাতারে এনে দাঁড়ি করিয়ে দিয়েছে। এটা রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জন্য একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।

চার.

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে চিন্তা এবং মতবাদের রাজনীতির যে সমন্বয় এটাই বাংলাদেশ। আমরা এমন বাংলাদেশ ই চাই। প্রয়োজনে যারা একসাথে লড়বে, একসাথে মরবে। এই আন্দোলন বাংলাদেশের মানুষকে যে ঐক্যের সুতোয় বেধেছে তার একটা রাজনৈতিক রিফ্লেকশন বিএনপির রাজনীতির সাথে দারুণ ভাবে মিলে যায়। সেটা হচ্ছে ঐক্য এবং সংহতির মিল বন্ধন।আমরা সবাই এক,আমরা সবাই বাংলাদেশী- এই চেতনাকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান আরো শক্তিশালী করেছে। বিএনপির বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক স্পিরিট এক মোহনায় মিলেছে। বৈচিত্র্য, ভিন্নতা এবং বহু মত ও পথের রাজনীতি আমাদের সমাজে আজকের বাস্তবতা।আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইনক্লুসিভ পলিটিক্সের বিকল্প তৈরি করা কঠিন। মানুষকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার,সম্মান পাওয়ার এবং মর্যাদা নিয়ে জীবন যাপনের রাজনীতি উপহার দিতে না পারলে আপনি যত আদর্শের কথাই বলেন না কেন, সেই রাজনীতি সোসাইটিতে কোনো ভ্যালু ক্রিয়েট করবে না। মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা দিতে না পারলে আপনার ইজমের পলিটিক্স কেউ গ্রহণ করবে না। বিএনপির রাজনীতির স্মার্টনেস এখানেই। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতির মূল জায়গাটা ধরতে পেরেছিলেন।সমস্যা এবং সম্ভাবনার মূল জায়গায় তিনি কাজ করেছেন।তিনি তাই মানচিত্রের ভেতরের মাটি ও মানুষের রাজনীতির স্বরুপ সন্ধান করেছেন।

পাঁচ.

বাংলাদেশে মোটা দাগে বড় যে তিনটি গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে তার মধ্যে উনসত্তর এবং নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে রাজনৈতিক নেতা এবং দল গুলো। সে হিসেবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দল গুলো অংশ নিলেও সাধারণত ছাত্র জনতাই এই লড়াইয়ের মূল নায়ক। এই ছাত্র জনতাকে যদিও রাজনৈতিক দল থেকে পৃথক করা কঠিন তবুও এটা সত্য এই লড়াইয়ের একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে এবং থাকবে ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের ইতিহাস। উনসত্তর এবং নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের চেয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনেক বেশি ইনক্লুসিভ।এই লড়াইয়ে বাংলাদেশের যেকোনো ঐতিহাসিক লড়াইয়ের চেয়ে অনেক বেশি শ্রেণি যুক্ত হয়েছে, অনেক বেশি ইনক্লুসিভ এই লড়াই।
সমাজের প্রতিটি শ্রেণি এক মোহনায় মিলিত হয়েছে ২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে।ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, ধনী, গরীব, দিনমজুর, রিক্সাওয়ালা,গার্মেন্টস শ্রমিক, চাকরিজীবী,বেকার,টুকাই,যাযাবর, নারী,শিশু, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী-কারা ছিল না জুলাই গণঅভ্যুত্থানে?একদিকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আর এক দিকে পুরো বাংলাদেশ। যে লড়াইয়ে বাংলাদেশ জিতেছে। বাংলাদেশের জনগণ জিতেছে।সেটা অনেক রক্ত, অনেক জীবনের বিনিময়ে।

ছয়.

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বৈচিত্র্যের মধ্যে এক ঐতিহাসিক জাতীয় ঐক্য বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় বৈচিত্র্যের মেল বন্ধন খুব জরুরী। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আদর্শিক রাজনৈতিক সংগঠনও কেন ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারে না?এর মূল কারণ তারা সব মানুষের জন্য রাজনীতি করে না। একটা শ্রেণি বিভাজন নিজেরাই সৃষ্টি করে রাখে।ফলে অটোমেটিক জনগণের সাথে একটা পাওয়ার ডিস্টেন্স কাজ করে। এটাও খেয়াল করে দেখা যায় যে আদর্শের দিকে কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো দলও ভোটের মাঠে বাজীমাত করে বসে!কারণ কী?এটা যার জন্য ঘটে তা হচ্ছে মানুষের হৃদয়ের ভাষা বুঝতে পারা এবং মানুষকে কানেক্টে করতে পারা।বিএনপির রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বিএনপির রাজনীতির সৌন্দর্য। অনেক সীমাবদ্ধতাও আছে, অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এই যে কনসেপ্ট এটা তো সব মানুষকে এক করে আগলে রাখে।বাংলাদেশে যারা বসবাস করে সবার কমন এক আইডেন্টিটি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের এক প্রেক্টিকাল পলিটিক্স আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেখলাম। ডান-বাম,কট্টরপন্থী, উদারপন্থী সবাই বাংলাদেশের প্রশ্নে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়ে গেল।খুব সহজ করে এটা বলাই যায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঐক্যের মূল জায়গা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের স্পিরিট। আমরা সবাই বাংলাদেশী -এই চিন্তাই বাংলাদেশের ছাত্র জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।

সাত.

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। যে বাংলাদেশ হবে সব মানুষের, যেখানে কোনো জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন থাকবে না। রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে ইনসাফ বা ন্যায় ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাংখা এখন সর্বত্র। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা একটা সুযোগ এবং সম্ভাবনা। এই সময় এবং সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে রাজনৈতিক দল গুলো।সে ক্ষেত্রে বিএনপির করার অনেক কিছু আছে। বড় দল হিসাবে দায়িত্ব অনেক বেশি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বাস্তবায়ন করতে চাইলে রাজনৈতিক দল গুলোর স্বদিচ্ছা ছাড়া অসম্ভব। বিএনপি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক দর্শনকে ধারণ করে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে সমাজের সৎ,যোগ্য এবং ভালো মানুষ গুলোকে রাজনীতিতে আহ্বান জানাচ্ছে। একটি ইনক্লুসিভ পলিটিক্স করতে দলটি তার কর্ম পরিকল্পনা সাজাচ্ছে।জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করে বিএনপি আগামী দিনে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে। যে বাংলাদেশ হবে আপনার, আমার,সবার। একটি কল্যাণ মুখী রাষ্ট্রের আকাংখা থেকেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি। ইনক্লুসিভ পলিটিক্স ছাড়া জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। বিএনপি জনগণের আকাংখার সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই কাজ করে যাচ্ছে।শত শত শহিদের এই মহান আত্মত্যাগকে কোনো ভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় সুশাসনের প্রতি কমিটমেন্ট আছে এমন একটা উদারপন্থী রাজনীতি লাগবেই। বিএনপিকেই সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক