মু. আবদুল হাকিম আমাদের রাষ্ট্রের নাম গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণের মালিকানার পাট্টা দলিল হচ্ছে এই সংবিধান। দেশের মধ্যে হীরা বা সোনার খনি পাওয়া গেলে তা হিস্যা অনুযায়ী জনগণকে ভাগ করে দিতে হবে। যদিও বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রের মালিক কে তা বলা নেই। সংবিধানে এ মালিকানা দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। না থাকলে সোনা বা হীরার হিস্যা জনগণ নাও পেতে পারে। এস আলম বা সালমান এফ রহমানের মত স্বার্থান্বেষী মহল বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখিয়ে তা হাতিয়ে নিতে পারে। জনগণ যদি সত্যি সত্যি রাষ্ট্রের মালিক হয় তাহলে অফিস আদালতে তাদের সেইভাবে সমাদর করতে হবে এবং কাঙ্ক্ষিত সেবাটি দ্রুততম সময়ে বিনামূল্যে হস্তান্তর করতে হবে ।
সংবিধানে বলা আছে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। তবে এই ক্ষমতার প্রয়োগ হবে সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে । এ সব অনুচ্ছেদ গুলোর জন্য সাংবিধানিক কর্তৃত্ববাদ এদেশে এত মজবুত । সংবিধানে প্রতিটি শব্দ,কমা ও সেমিকোলন মেপে মেপে বসাতে হবে। না হলে বিপত্তি ঘটবে। তাহলে সার্বভৌম কে ? জনগণ না সংবিধান ? সাংবিধানিক আইনের এই মারপ্যাঁচে একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এমন কি গৃহযুদ্ধে দেশ ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। এই ধ্বংস এড়াতে হলে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি থাকতে হবে। লড়াকু এবং হ্যাডমওয়ালা রাজনীতিবিদগণ যাদেরকে সুশীল বলে টাট্টা বিদ্রূপ করে ভীষণ মজা পায়।
সিভিল সোসাইটির অন্তর্ভূক্ত কারা ? শৃঙ্খলা বাহিনী বা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় নেতা কর্মী ব্যতীত সকলেই। একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কে কি সংবিধান বানাতে দেয়া সমীচীন ? তা সে যতই জনপ্রিয় দল হোক । যদি সমীচীন হয় তাহলে তারা এমন ভাবে সংবিধান বানাবে যাতে তারা চিরকাল ক্ষমতায় থাকে এবং অন্য কোনো দল যেনো কোনোদিন ক্ষমতায় আসতে না পারে। জ্ঞানপাপীদের দিয়ে কোনো দলের পক্ষে এ জাতীয় সংবিধান বানানো কি অসম্ভব ? জনগণকে তো আপনি রাজনীতি থেকে আলাদা করতে পারবেন না। কেননা রাজনীতি করা জনগণের জন্মগত অধিকার। এটা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। একটি দেশের জনগণ কে আপনি দলে দলে ভাগ করতে পারবেন না । কিছু লোক নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ থাকবেই। দেশের অধিকাংশ জনগণ শুধুমাত্র ভোটার। কোনো দলের ক্যাডার নয়। সব মানুষ কে যদি দলীয় ক্যাডারে ভাগ করা হয় তাহলে দেশে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। উদার গণতান্ত্রিক দেশে ক্যাডার রাজনীতি অচল ।
সংবিধানে দলীয়তা ও নির্দলীয়তাকে সংজ্ঞায়িত করে রাষ্ট্রে দলীয় ও নির্দলীয় রাজনীতির বন্দোবস্ত থাকতে হবে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সিভিল সোসাইটির হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা থাকে না। রাষ্ট্র ক্ষমতা থাকে দলের হাতে। রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগকারীদের সংবিধান বানানোর দায়িত্ব ন্যস্ত করা অসমীচীন । বরং সিভিল সোসাইটি থেকে সংবিধান সভা বা গণ পরিষদ গঠন করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত এবং সমীচীন। নিম্নকক্ষ দলীয় থাকলে ভারসাম্যের জন্য উচ্চকক্ষ হবে নির্দলীয়। কেন্দ্রীয় সরকার দলীয় থাকলে স্থানীয় সরকার হবে নির্দলীয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা দলীয় সরকারের হাতে থাকলে উচ্চ শিক্ষাকে অবশ্যই নির্দলীয় কমিশনের হাতে রাখতে হবে। তথ্য,জ্ঞান ও পরিসংখ্যান তথ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের হাতে থাকলে এক দল দলীয় জ্ঞান পাপী এগুলোকে দলীয় প্রোপাগান্ডা মেশিনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করবে। নির্দলীয় তথ্য কমিশনে ন্যস্ত হলে যার কোনো আশংকা থাকে না।
ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতা থেকে সাংবিধানিক দুর্নীতি দমন কমিশনে ন্যস্ত করে কমিশনকে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। বিসিএস(এটর্নি সার্ভিস) চালু করে এই সার্ভিস কে নির্দলীয় করতে হবে। সাংবিধানিক স্থানীয় সরকার কমিশন সৃষ্টি করে স্থানীয় সরকারগুলোকে মন্ত্রণালয় থেকে কমিশনের আওতায় আনতে হবে । স্থানীয় সরকারে নির্দলীয় রাজনীতি প্রবর্তন করতে হবে। দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। নির্দলীয় রাজনীতি মানে সিভিল সোসাইটি রাজনীতি। রাষ্ট্র ও সরকারকে দলীয় ও নির্দলীয় সত্তায় বিভক্ত করে রাষ্ট্র ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপন করতে হবে। সিভিল সোসাইটি এবং দলীয় সরকার পারস্পারিক নজরদারি এবং জবাবদিহিতার আওতায় স্বচ্ছভাবে জনস্বার্থে কাজ করবে। গণমাধ্যম তথ্যের জন্য উভয়ের দ্বারস্থ হবে। কেবলমাত্র মাত্র দলীয় রাজনীতি সমাজের কোনো টেকসই কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে না। এই সাংবিধানিক প্রজ্ঞা বা হিকমা বা মুন্সিয়ানা দিয়ে যদি আমরা সংবিধান বানাতে না পারি তাহলে আমাদের খবর আছে।
সিভিল সোসাইটি অক্ষে কারা থাকবে ? থাকবে ছাত্র, শিক্ষক, আমলা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষক এবং শ্রমিক সহ সকল পেশাজীবী সমপ্রদায়। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি থাকবে না। কোনো পেশাজীবী সংগঠন রাজনৈতিক দলের অংগ সংগঠন হবে না। সংবিধানে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে জনগণের মৌলিক অধিকারের তালিকা বা বয়ান অনেক লম্বা হবে। অধিকারগুলো আদায়ের জন্য জেলায় জেলায় মানবাধিকার আদালত হবে। দলীয় সরকারের জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অফিস আদালত ব্যবহার করে দমন পীড়ন অব্যাহত রাখাকে অসম্ভব করে তুলতে হবে। সংবিধানে দুইটা অংশ থাকে একটা হল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার কাঠামো এবং অন্যটি হচ্ছে সরকারের ক্ষমতা কাঠামো । প্রথমটি জনগণকে সরকারের দমন পীড়ন থেকে রক্ষা করে, জনসেবার গ্যারাণ্টি প্রদান করে, জনগণকে ইনসাফ ও ন্যায্যতার নিশ্চয়তা দেয় এবং সরকারকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দিতে বাধ্য করে । প্রথমটির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল সমূহ খুব একটা আগ্রহী নয়।
কিন্তু সিভিল সোসাইটি আগ্রহী। দ্বিতীয়টি ভারসাম্য বজায় রেখে রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংগসমূহের মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বন্টনের একটি বন্দোবস্ত। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সিভিল সোসাইটি আগ্রহী নয় । কিন্ত রাজনৈতিক দল সমূহ প্রচ্লভাবে আগ্রহী। সরকার এমন একটি রাজনৈতিক সংগঠন যে সব সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের উপর যুলুম করতে চায়। একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সিভিল সোসাইটি সংবিধান ও আদালতের সাহায্য নিয়ে সরকারের নির্যাতন ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে। ফলশ্রুতিস্বরূপ রাষ্ট্রে সৃষ্টি হয় ইনসাফ, ন্যায্যতা এবং ন্যায় বিচার। সিভিল সোসাইটি মানবাধিকার রক্ষার শেষ ভরসা। এমতাবস্থায় সংবিধান বানানোর দায়িত্ব দলগুলোর মতামত সাপেক্ষে সিভিল সমাজের হাতে থাকাই সর্বোত্তম।