Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 12:10 pm

রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় ক্ষুব্ধ এমপিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: সারা দেশে রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তিন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে গতকাল এক মতবিনিময় সভায় তারা বলেন, এলাকায় গেলে মানুষের সামনে মুখ দেখানো যায় না। ভোটারদের সামনে লজ্জায় পড়তে হয়। মানুষ রাস্তাঘাটের নাজুক অবস্থার কারণ জানতে চায়। নতুন একটি রাস্তা হওয়ার পর ছয় মাস না যেতেই কীভাবে ওই রাস্তা নষ্ট হয়Ñএলাকার মানুষ তার ব্যাখ্যা চায়। সংসদ সদস্যদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। রাস্তাঘাটের অবস্থা এত খারাপ যে, জনগণকে কোনো জবাব দেওয়ার ভাষা থাকে না।

পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সংসদ সদস্যরা এসব মন্তব্য করেন। মতবিনিময় সভাটি ছিল মূলত বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ নিয়ে। সভায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্য উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান ও এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদও মতবিনিময়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

তারা বলেন, বিটুমিন দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করলে সেটি বেশিদিন স্থায়ী হয় না। অল্প দিনেই নষ্ট হয়ে যায়। আর কংক্রিটের সড়ক টেকসই হয়। অনেক দিন টেকে। বিটুমিনে রাস্তা নির্মাণ করলে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। রাস্তা সংস্কারের নামে নয়-ছয় হয়। কংক্রিটে রাস্তা নির্মাণ করলে সে সুযোগ থাকে না।

তবে সংসদ সদস্যদের এ মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন প্রকৌশলীরা। বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী বলেন, বিটুমিনে রাস্তাঘাট নির্মাণ করলে সেটা অনেক সাশ্রয়ী। কংক্রিটে নির্মাণ করলে খরচ বেশি। তাছাড়া কংক্রিটে সড়ক নির্মাণ করলে সেখানেও অনিয়মের সুযোগ থাকে।

গতকালের মতবিনিময়ে সাংবাদিকদের থাকার সুযোগ ছিল না। তবে বৈঠকে অংশ নেওয়া সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক পরে জানান, রাস্তাঘাট বিটুমিন, না কি কংক্রিটে নির্মাণ করা হবেÑবিষয়টি নিয়ে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন প্রকৌশলীরা।

সব পক্ষের মতামত শেষে নিজ কার্যালয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, কংক্রিটে সড়ক নির্মাণ কতটা যৌক্তিকÑতা যাচাই-বাছাইয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হবে। সে কমিটিতে তিন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দুজন করে সদস্য থাকবেন। কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মিল আছেÑএমন কয়েকটি দেশ পরিদর্শনে যাবেন। সেসব দেশের রাস্তা কীভাবে নির্মাণ হয়, তা দেখে এসে একটি প্রতিবেদন দেবেন। কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।

১৫ দিনের মধ্যে এ প্রতিবেদন দেওয়া হবে। সময় কিছুটা বেশিও লাগতে পারে। মন্ত্রী আরও বলেন, দেশের যেসব স্থানে বাজার আছে, সেখানে রাস্তা কংক্রিটে নির্মাণের বিষয়টি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া দেশের যেসব রাস্তার পাশে পুকুর আছে, সেসব স্থানে সরকার রিটেইনিং ওয়াল করে দেবে। যাতে রাস্তাঘাট না ভাঙে।

মতবিনিময় সভায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, যেসব জেলায়ই যাই; রাস্তাঘাট অনেক খারাপ। মানুষ জানতে চায় রাস্তাঘাট নির্মাণ নিয়ে এসব কী হচ্ছে। যাদের টাকায় আমাদের বেতন হয়, তাদের কী জবাব দেব। তিনি বলেন, প্রকৌশলীরা এখানে বলেছেন, বিটুমিনের চেয়ে কংক্রিটে খরচ বেশি। খরচ বেশি হলে হবে। একটি রাস্তা টেকসই হলে তো তার খরচ বেশি হবেই। সেটা সরকার দেখবে। প্রকৌশলীর দায়িত্ব কাজ করা, খরচ দেখা নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ায় অনেক পরিবর্তন আসছে। এখন অনেক বেশি বৃষ্টি হয়। আর বিটুমিনের প্রধান শত্রু বৃষ্টি। বিটুমিনের সড়ক নির্মাণ করলে অল্প দিনেই নষ্ট হয়ে যাবে। সড়ক টেকসই রাখতে হলে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের বিকল্প নেই।

চাঁদপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, একটি নতুন রাস্তা হওয়ার পর এক বছরও টেকে না। নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আমার কাছে জানতে চায়Ñস্যার, নতুন একটি রাস্তা তো অন্তত কয়েক বছর টেকার কথা। এক বছরও কেন যায় না! আমি তাদের কোনো জবাব দিতে পারি না। জনগণ আমাদের সন্দেহ করছে আমরা টাকা মেরে খাচ্ছি কি না। অথচ এর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

পঞ্চগড়ের সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান বলেন, নির্মাণকাজে প্রচুর পুকুর চুরি হয় বলে মানুষ মনে করে। আগে যানবাহন বেশি ছিল না। এখন বেড়েছে। তিনি বলেন, কোন কোন এলাকায় বিটুমিনের সড়ক করা উচিত আর কোন কোন এলাকায় কংক্রিটের সড়ক করা উচিত, আগে সেটা বের করতে হবে। সেজন্য একটি কমিটি করা উচিত। তবে কংক্রিট অনেক মজবুত হয়। যেটা বিটুমিনে হয় না।

কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রধান সমস্যা রাস্তাঘাট নির্মাণে গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারি না। নানা অনিয়ম হয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্রামের রাস্তাঘাটে ট্রাক্টর ঢোকা। ট্রাক্টর থেকে মাটি পড়ে রাস্তা নষ্ট হচ্ছে।

এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বিটুমিনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, এক কিলোমিটার সড়ক কংক্রিটে নির্মাণে খরচ হয় ১১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে বিটুমিনে খরচ হয় ৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। যুক্তরাষ্ট্রে ৮৬ শতাংশ গ্রামীণ এবং ৭৮ শতাংশ শহরের সড়ক বিটুমিনের। বিটুমিনে সংস্কার সুবিধা। নির্মাণ ও মেরামতও সহজ। শব্দদূষণ কম হয়। ধাপে ধাপে নির্মাণ করা যায় বিটুমিনে। অন্যদিকে কংক্রিটে সংস্কারের সুযোগ নেই। শব্দদূষণ বেশি। এক সঙ্গে নির্মাণ করতে হয়।

পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, রাস্তা নির্মাণে খরচ বেশি হলে সেটা সরকার বুঝবে। এটা প্রকৌশলীদের দেখার দায়িত্ব নয়। যেটা লাভজনক, আমরা সেটাই দেখব। রাস্তাঘাট টেকসই দেখতে চাই আমরা। তবে এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা হবে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রীও একই মত পোষণ করেন।