রোহান রাজিব: দেশের ডলার সংকটের সময় ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন ঊর্ধ্বমুখী। সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেনের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ২১৬ শতাংশ। এতে করে রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রাহকরা কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় ৫৮৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা লেনদেন করেন; যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৮৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রায় ৪০০ কোটি ২০ লাখ টাকা বেশি বা ২১৬ শতাংশ।
ব্যাংকাররা জানান, সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তরা প্রায়ই এখন বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন। এছাড়া চিকিৎসা, শিক্ষা ও ব্যবসার কাজেও অনেকে বিদেশে ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। যারা বিদেশে যাচ্ছেন তারা কার্ডে ডলার এনডোর্সমেন্ট করে নিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন বেড়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো এসব ক্ষেত্রে কার্ডে লেনদেন করতে গ্রাহকদের উৎসাহিত করছে। তাই বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন বেড়েছে। আর কার্ডে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের ফলে রিজার্ভের ওপর বাড়তি একটি চাপ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দিনশেষে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময় রিজার্ভের এ অঙ্ক ছিল ৪৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ ১০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার কমেছে। এছাড়া গত এক বছরে মার্কিন ডলারের দামও বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম ২১ টাকা বৃদ্ধি পায়। গত ১৪ নভেম্বর ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৬ টাকা ৮৮ পয়সা। আর গত বছরের ৯ নভেম্বর এ হার ছিল ৮৫ টাকা ৭৫ পয়সা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, কার্ডে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন গত এপ্রিল থেকে টানা বাড়ছে। ওই মাসে কার্ডে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৪১ কোটি টাকা। এটি গত মে মাসে বেড়ে হয় ৩৫৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এরপর জুনে আরও বেড়ে হয় ৩৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। জুলাই মাসে তা ৪৪২ কোটি ছাড়িয়ে যায়। আর আগস্টে আরও বেড়ে ৫২০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকগুলো এখন গ্রাহকদের বিদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডে লেনদেন করতে উৎসাহিত করছে। এর ফলে মানুষ এখন ভ্রমণের ক্ষেত্রে কার্ডে লেনদেন করছে। তাই বিদেশি মুদ্রায় আগের তুলনায় এখন লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও চায়Ñগ্রাহক নগদ লেনদেন থেকে সরে আসুক। এরকম ডিজিটাল লেনদেন করুক।
দেশে অনেক আগেই ক্রেডিট কার্ডে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের অনুমোদন দেয়া হয়। পরে ২০২০ সালের জুনে ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকদের হিসাবের বিপরীতে আন্তর্জাতিক ডেবিট কার্ড ইস্যুর অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দ্বৈত মুদ্রার এসব কার্ড দিয়ে দেশে বসে বিদেশের হোটেল বুকিং, নির্দিষ্ট পরিমাণের কেনাকাটাসহ নানা খরচ করা যাচ্ছে। এছাড়া বিদেশে যাওয়ার সময়ও অনেকে কার্ডেই বৈদেশিক মুদ্রা এনডোর্সমেন্ট করে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, কার্ডে বছরে খরচ করা যাবে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার। গ্রাহকদের কাছে নগদে ও কার্ডে দুভাবেই ডলার বিক্রি করে ব্যাংক। এতদিন নগদের চেয়ে কার্ডে ডলার নেয়ার খরচ ছিল কম। তবে সম্প্রতি বাফেদা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কার্ডের ডলারের বিনিময় মূল্য হবে নগদ ডলারের মতো। ভোক্তারা দেশের বাইরে কার্ড ব্যবহার করে কিছু কিনলে ব্যাংকগুলো প্রতি ডলারে ১০৪ থেকে ১০৫ টাকা করে চার্জ করছে। এক বছর আগে এই খরচ ৮৮ থেকে ৮৯ টাকার মধ্যে ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা মোট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৮৫১টিতে। এর মধ্যে ডেবিট কার্ড ২ কোটি ৮৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫২টি। ক্রেডিট কার্ড ২০ লাখ ৩৭ হাজার ৫৯৮ ও প্রিপেইড কার্ড রয়েছে ৩০ লাখ ৯৯ হাজার ২০১টি। সংখ্যার মতো কার্ড লেনদেনের সিংহভাগই হয় ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে।
সেপ্টেম্বরে ডেবিট কার্ডে ৩৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। প্রি-পেইড কার্ডে লেনদেন হয়েছে ৩২৮ কোটি টাকা।
গত এপ্রিলে শুরু হওয়া ডলার-সংকট এখনও কাটেনি। বরং দিনে দিনে তা প্রকট হচ্ছে। আগে সংকট মেটাতে ব্যাংকগুলো বেশি দামে প্রবাসী আয় এনে আমদানি দায় শোধ করছিল। এখন সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। প্রবাসী আয়ে ডলারের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে। এতে কমেছে প্রবাসী আয়, রপ্তানিও নি¤œমুখী। বিদেশি ঋণ ছাড়ও কমে গেছে। পাশাপাশি বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে এনেছে।