রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি থামছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা কড়াকড়িতে আমদানি কমলেও কাটছে না ডলার সংকট। তাই বাজার সামলাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বৃহস্পতিবার কয়েকটি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হয় ৬৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের চার মাস দুই দিনে বিক্রির পরিমাণ গিয়ে ঠেকেছে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জ্বালানি, সার ও খাদ্য আমদানির জন্য এই ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় কমছে। পাশাপাশি বিদেশি ঋণ পাচ্ছে কম, পরিশোধ হচ্ছে বেশি। তাই এখনও দেশে ডলার সংকট রয়ে গেছে, যার কারণে বাধ্য হয়ে সরকারের আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। আগের বছরের একই সময়ে ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সূত্রমতে, ধারাবাহিকভাবে বাজারে ডলার বিক্রি করার কারণে রিজার্ভের ক্ষয় হচ্ছে। এখনই ডলার সংকট কাটাতে না পারলে রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায় ওঠে। ওই বছরের আগস্ট মাসে রিজার্ভ উঠেছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রির কারণে তা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ২৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী, ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। চলতি সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আমদানি দায় পরিশোধ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে রিজার্ভ আরও কমে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যাবে।

জানা যায়, রিজার্ভ বাড়াতে ও আর্থিক হিসেবের ঘাটতি কমাতে বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণের খোঁজে নামছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ নিতে ভারত ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার পরিকল্পনাও করা হয়েছে। সম্প্রতি ১৫ জন বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে আলোচনার সময় এ অবস্থান তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। 

ডলার সংকট ও বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে আমদানি অনেক কমেছে। এতে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। তবে বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ কমে যাওয়া রেকর্ড আর্থিক ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টম্বর সময়ে আমদানি কমেছে ২৪ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানি কমেছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে ১৮২ কোটি ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৭৫৮ কোটি ডলার। এদিকে বিদেশি ঋণ কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৩ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডলারের দর বাজারভিত্তিক না হওয়ার কারণে হুন্ডি প্রবণতা বেড়েছে। তাই প্রবাসী আয় বৈধ পথে না এসে অবৈধ পথে আসছে বেশি। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ না আসার কারণে ডলার সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। তাই ডলার দর বাজারভিত্তিক ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, গত এক বছর দেশের রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। বর্তমানে দেশের রেমিট্যান্স ও

 রপ্তানি আয় না বাড়ার কারণে ডলার সংকট রয়েছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার রেট বাজার করার পরামর্শ দিয়েছি। কারণ রিয়েল ইফেকটিভ এক্সচেঞ্জ রেট বর্তমানে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারণ করা রেটের চেয়েও বেশি। এক্ষেত্রে ডলারের দাম একসঙ্গে অ্যাডজাস্ট না করতে পারলেও দ্রæততার সঙ্গে করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন  বলেন, আর্থিক সংকট নিরসনে ডলারের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা খুবই জরুরি। কিন্তু এবিবি ও বাফেদা দাম বেঁধে দেয়ার কারণে দামে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তাই ডলারের দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা না গেলেও ধাপে ধাপে সেদিকে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সংকট আরও গভীর হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এর পর থেকেই সংগঠন দুটি মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন।

বর্তমানে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা বাড়িয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় কিনে আমদানিকারকদের কাছে ১১১ টাকায় বিক্রি করবে ব্যাংকগুলো। এত দিন ১১০ টাকায় ডলার কিনে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রির সিদ্ধান্ত ছিল। আর এখন ব্যাংকগুলোর প্রতি মাসের রেমিট্যান্সের ১০ শতাংশ আন্তঃব্যাংক মার্কেটে বিক্রি করতে হবে, যার সর্বোচ্চ দর হবে ১১৪ টাকা।

এদিকে ওই বৈঠকে ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স আয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার সীমা তুলে নিয়েছে এবিবি ও বাফেদা। এখন থেকে কোনো ব্যাংক চাইলে ইচ্ছামতো প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারবে। তবে একটি ব্যাংক কত শতাংশ প্রণোদনা দেবে, তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বোর্ড থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০