নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ছয় লাখ ৬৪ হাজার ডলার হ্যাকিং হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলা প্রথম পরাজয় হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের। দায়ের করা মামলায় ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। প্রতিষ্ঠান দুটো হচ্ছে ব্ল–মবেরি ও ইস্টার্ন হাওয়াই নামের ক্যাসিনো।
এতে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে প্রথম দফায় হারল বাংলাদেশ ব্যাংক। মামলা লড়তে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইনি প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। গত ৮ এপ্রিল এ বিষয়ে রায় হলে জানিয়েছে অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান। ফিলিপাইনের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ায় তারা বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের অবহিত করে। তারপরই বিষয়টি গণমাধ্যমে আসে।
অবশ্য মামলায় হেরে যাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের অনুরোধে লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, “রিজার্ভ চুরির মামলা রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকসহ (আরসিবিসি) সংশ্লিষ্ট ১৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২০২০ সালের ২৭ মে মামলাটি করা হয়। এজন্য ‘কোজেন ও-কনর’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানকে মামলা পরিচালনার জন্য নিযুক্ত করা হয়। গত ৮ এপ্রিল নিউইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্ট আলোচ্য মামলার আংশিক রায় দেন। আদলাত ব্ল–মবেরি ও ইস্টার্ন হাওয়াইকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তবে আদালত কিম ওঙ-এর সিমিসাল আবেদন খারিজ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কমপ্লেইন্ট (অভিযোগের) জবাব দিতে নির্দেশনা দিয়েছে। মূল আসামি আরসিবিসির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষেই রায় করবে বলে নিযুক্ত আইনি প্রতিষ্ঠান আশা করছে।”
নিউইয়র্কের সুপ্রিম কোর্ট রায়ে ‘পর্যাপ্ত এখতিয়ার নেই’ উল্লেখ করে তিন বছর আগে করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এ মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরসিবিসি, লোরেঞ্জো টান, রাউল টান ও কিম অং নিউইয়র্কের সুপ্রিম কোর্টে আলাদা আলাদা আবেদন করেন। এর মধ্যে গত বছরের ১৪ জুলাই ব্ল–মবেরি, ইস্টার্ন হাওয়াই ও কিম জংয়ের অব্যাহতির আবেদন শুনানি হয়।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি হয়। যার মধ্যে আট লাখ ৬৪ হাজার ডলার এখনও ফেরত আসেনি। বিশ্বজুড়ে আলোচনা সৃষ্টিকারী কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়া এ অর্থ প্রথমে গিয়েছিল ফিলিপাইনের মাকাতি শহরের রিজাল ব্যাংকের ৪টি ভুয়া অ্যাকাউন্টে। তারপর সেখান থেকে দ্রুত এই অর্থ উত্তোলন করেন হ্যাকাররা।
রিজার্ভের একটি অংশ উদ্ধারে তিন বছর আগে নিউইয়র্কের আদালতে মামলা দায়ের করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই মামলা খারিজ করে দিয়ে গত ৮ এপ্রিল নিউইয়র্কের আদালত বলেছেন, বিচারের পর্যাপ্ত এখতিয়ার না থাকায় ব্ল–মবেরি রিসোর্টস করপোরেশন মামলা খারিজ করে দিতে যে আবেদন করেছিল, তা মঞ্জুর করা হয়েছে। আদালতে দায়ের করা মামলায় রিজার্ভ চুরি, অপব্যবহার, জালিয়াতির ষড়যন্ত্র এবং প্রতারণায় সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এ মামলায় আরসিবিসি, কেন্টুরিটেক্স ট্রেডিং, ইস্টার্ন হাওয়াই লেজার কোম্পানি, মিডাস হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনো এবং ব্ল–মবেরি রিসোর্টসকে আসামি করা হয়েছে। জানা গেছে, রিজার্ভের ওই অর্থ স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোয়। এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে ফিলিপিন্স সরকার বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দিলেও, বাকি ছয় কোটি ৬৪ লাখ ডলার উদ্ধারের বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
জুয়ার টেবিলে হাতবদল হয়ে ওই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে, তারও কোনো হদিস মেলেনি। রিজার্ভ চুরির তিন বছরের মাথায় ওই অর্থ উদ্ধারের আশায় নিউইয়র্কের ম্যানহাটন সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে একটি মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক চুরি যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা, ক্ষতিপূরণ ও আদায়ে এ মামলা দায়ের করেছিল বলে ২০১৯ সালের অক্টোবরে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
ওই সময় মামলা নিষ্প?ত্তিতে তিন বছরের মতো সময় লাগতে পারে বলে ধারণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি। আজমালুল হোসেন জানান, মামলার ১০৩ পৃষ্ঠার এজাহারে ১৫ জন ব্যক্তি ও সাতটি প্রতিষ্ঠানকে এ মামলায় বিবাদী করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ২৫ জনকে রাখা হয়েছে বিবাদীর তালিকায়।
কয়েক বছর ধরে ‘জটিল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে’ আসামিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে। তিন বছর পরই গত ৮ এপ্রিল এ রায় হয় বলে জানায় এনকোয়ারার ডটকম। সংবাদ মাধ্যমটি জানায়, আরসিবিসি ব্যাংকসহ ফিলিপাইনের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দায়ের করা এ মামলায় অর্থ সরিয়ে নেয়া/চুরি/অপব্যবহার, ষড়যন্ত্র ও প্রতারণায় সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এর আগে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফিলিপিন্সের পক্ষ থেকে তাদের দেশের আদালতে একটি মামলা করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ওই মামলার রায়ে আরসিবিসির শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগিতোকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন আদালত। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলাতেও তাকে আসামি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে মতিঝিল থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে যে মামলাটি করা হয়েছিল, সেখানে সরাসরি কাউকে আসামি করা হয়নি। তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ আদালতে এখনও প্রতিবেদন দিতে পারেনি।