সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ

রিটার্নে তথ্য ভুল দিলে বিপদ গোপন করলেও বিপদ

রহমত রহমান: সফিউল ইসলাম একজন বড় ব্যবসায়ী। রকিবুল হক একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। নজরুল ইসলাম একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনজনই করদাতা। তিনজনই কর সুবিধা আর কর রেয়াত পেতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন।

তিনজনের মধ্যে সফিউল ইসলাম সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন ৫০ লাখ টাকা, কিন্তু আয়কর রিটার্নে দেখিয়েছেন ৩০ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের তথ্য গোপন করায় সফিউল ইসলামের জন্য আসছে বিপদ। আবার রকিবুল হক ২০ লাখ টাকা তিন বছরের জন্য সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু প্রথম বছর কর সুবিধা আর রেয়াত নিলেন। দ্বিতীয় বছর সঞ্চয়পত্র ভেঙে টাকা তুলে নিলেন। রেয়াতের শর্ত ভঙ্গ করায় রকিবুল হকের জন্য আসছে বিপদ। নজরুল ইসলাম পাঁচ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন, কিন্তু রিটার্নে এই তথ্য দেখাননি। তথ্য গোপন করায় নজরুল ইসলামের জন্যও আসছে বিপদ।

আয়কর রিটার্নে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের তথ্য গোপন ও রেয়াতের শর্ত ভঙ্গ করলে শুধু সফিউল ইসলাম, রকিবুল হক আর নজরুল ইসলাম নয়, সব করদাতাই বিপদে পড়বেন। কারণ করদাতার রিটার্নের সঙ্গে দেয়া বা না দেয়া সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের তথ্য যাচাই শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ডেটাবেইস থেকে করদাতার এসব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।

প্রাথমিকভাবে পাঁচটি কর অঞ্চল তাদের অধিক্ষেত্রাধীন করদাতাদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সঠিকতা যাচাই করেছে, যাতে ভালো ফল পেয়েছে। পর্যায়ক্রমে ৩১টি কর অঞ্চলকে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের দেয়া ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেয়া হচ্ছে। এর ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের তথ্য গোপন করে কর সুবিধা নেয়া বন্ধ হবে এবং রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে মনে করেন এনবিআর কর্মকর্তারা। তবে এনবিআরের সঙ্গে সঞ্চয় অধিদপ্তরের ইন্টিগ্রেশন হয়ে গেলে কর কর্মকর্তারা সহজেই করদাতার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের তথ্য যাচাই করতে পারবেন। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর সূত্রমতে, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে করছাড় বা রেয়াত সুবিধা পাওয়া যায়। তবে এ সুবিধা পেতে হলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকৃত অঙ্ক আয়কর রিটার্নে অবশ্যই দেখাতে হবে। কত টাকার বিনিয়োগ করলে কত হারে ছাড় পাওয়া যায়, পরিপত্রে তা উল্লেখ আছে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ৪৪(৪)বি ধারা অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কয়েকটি খাতে বিনিয়োগ করলে করদাতা রেয়াত পাবেন। এক্ষেত্রে করদাতার মোট আয়ের ওপর আরোপযোগ্য আয়করের পরিমাণ থেকে কর রেয়াত বাদ দিলে প্রদেয় করের পরিমাণ পাওয়া যায়। রেয়াত অনুমোদনের জন্য তিনটি অঙ্ক হবে রেয়াত পাওয়ার যোগ্য খাতে করদাতার প্রকৃত বিনিয়োগ, করযোগ্য মোট আয়ের ২৫ শতাংশ ও মোট আয় সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা। তিনটির মধ্যে যেটি কম তার ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রেয়াত পাওয়া যাবে। এর মধ্যে বর্তমান সঞ্চয়পত্রে বিনিয়াগ করলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কর ছাড় পাওয়া যায়। আর আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর ৫ ও ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হয়।

সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ মুনাফার হার রয়েছে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক শূন্য চার শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে স্তরভেদে ১২ থেকে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ হতে পারে এই মুনাফার হার। জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে বিনিয়োগ করা অর্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর মুনাফা দেয় সরকার। মেয়াদপূর্তির পর বিনিয়োগ করা অর্থও ফেরত দেয়া হয়। বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সর্বশেষ ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার গড়ে দুই শতাংশ করে কমানো হয়েছিল। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। তাছাড়া ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর সরকার জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সীমাও কমিয়ে দেয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী একক নামে ৫০ লাখ এবং যৌথ নামে এক কোটি টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।

সম্প্রতি এনবিআরের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, এনবিআরের সাথে যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের এরই মধ্যে ফাংশানাল অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) সম্পন্ন হয়েছে, তার মধ্যে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অন্যতম। কর অঞ্চলগুলোর করদাতাদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সঠিকতা সঞ্চয় অধিদপ্তরের সাথে ‘ক্রস চেক’ করার জন্য এর আগে পরীক্ষামূলকভাবে পাঁচটি কর অঞ্চলকে ‘টেস্ট ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড’ দেয়া হয়েছে। এসব কর অঞ্চলের করদাতাদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সঠিকতা সফলভাবে ক্রস চেক করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩১টি কর অঞ্চলের জন্য ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড তৈরির কার্যক্রম জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর কর্তৃক চলমান রয়েছে। এই ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড এনবিআরকে দেয়া হলে তা কর অঞ্চলগুলোকে দ্রুত দেয়া হবে। এরই মধ্যে বিআরটিএ’র সঙ্গে এনবিআরের এপিআই হয়েছে। ফলে বিআরটিএ’তে নিবন্ধিত মোটরগাড়ির তথ্য কর অঞ্চলগুলো যাচাই করতে পারছে। সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে বিনিয়োগ ও বিআরটিএ থেকে গাড়ির বিনিয়োগের তথ্য যাচাইয়ের ফলে কোনো গোপনীয়তা বা ফাঁকি পাওয়া গেলে আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী করদাতার রিটার্ন অডিট, পুন:উম্মোচন করাসহ অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এতে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আপাতত সঞ্চয় অধিদপ্তর আমাদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়েছে। আমরা এখন সঞ্চয় অধিদপ্তরের ডেটাবেইস দেখতে পারি। কোনো করদাতা আয়কর রিটার্নের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের তথ্য দিলে আমরা তা যাচাই করতে পারছি। কোনো করদাতা হয়তো বিপুল পরিমাণ সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, কিন্তু রিটার্নে দেখাননি। অথবা রিটার্নের সঙ্গে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের তথ্য দেয়নি, তখন আমরা সেই করদাতার সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে যাচাই করে নিতে পারি। আবার অনেক করদাতা কর রেয়াত নিতে রিটার্নের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের হয়তো ভুয়া কাগজপত্র দিয়েছেন। আমরা এখন যাচাই করে তা শনাক্ত করতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘কোনো করদাতা হয়তো পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন। প্রথম বছর সেই করদাতা রেয়াত নিয়ে যান। দেখা গেছে, ওই করদাতা এক বা দুই বছর পর সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলে আবার নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনে রেয়াত নেন। জানতে পারলে রেয়াতের শর্ত ভঙ্গ করায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি, কিন্তু সব ফাইল তো অডিট হয় না। ফলে অনেক করদাতা রিটার্নের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের তথ্য দিলেও আমরা যাচাই করতে পারি না। এখন ক্রস চেক করার ফলে হয়তো এ ধরনের ফাঁকি বন্ধ হবে। সঠিকভাবে যাচাই করতে পারলে রাজস্ব বাড়বে।’

এ বিষয়ে একাধিক কর কমিশনার এনবিআরের এই সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরই মধ্যে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে উপকর কমিশনাররা যাচাই করা শুরু করেছেন, যাতে ভালো ফলাফল আসছে। কমিশনাররা শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, ‘আমরা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছি। কোন কোন কর অঞ্চল প্রাথমিকভাবে যেসব করদাতার ৫০ লাখ টাকার ওপরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের তথ্য যাচাই করছে। পর্যায়ক্রমে সব যাচাই করা হবে। সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের তথ্য যাচাইয়ের ফলে বাস্তব বিনিয়োগ বের হয়ে আসবে, যাতে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকবে না।’

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছর সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৪ হাজার ৩৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর মূল টাকা পরিশোধ ৩৭ হাজার ৩৬৪ কোটি ৯০ লাখ, সুদ পরিশোধ ৩২ হাজার ৮০০ কোটি এবং নিট পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ২৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬৭ হাজার ১২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। মূল টাকা পরিশোধ করা হয়েছে ৫২ হাজার ৬৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা, সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ২৮ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এছাড়া নিট পরিশোধ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের হার ১০৪ শতাংশ, মূল টাকা পরিশোধের হার ১৪১ শতাংশ, সুদ পরিশোধের হার ৮৬ শতাংশ ও নিট পরিশোধের হার ছিল ৫৩ শতাংশ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০