রিটার্ন জমার ভুয়া ‘প্রমাণপত্র’ দিলেই অনলাইনে শনাক্ত

রহমত রহমান: ২০১৮ সালে ব্যাংক হিসাব খুলতে ই-টিআইএন নিবন্ধন করেন উদ্যোক্তা কানিজ ফাতেমা। এ ই-টিআইএন সনদ দিয়েই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। তবে রিটার্ন দাখিল করেননি। সম্প্রতি ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলে ব্যাংক তাকে জানিয়ে দেয়, ই-টিআইএন সনদ নয়, আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (প্রাপ্তি স্বীকার) দাখিল করতে হবে। তড়িঘড়ি করে সম্প্রতি তিনি রিটার্ন দাখিল করে প্রমাণপত্র ব্যাংকে জমা দিয়েছেন। এত অল্প সময়ে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখে ব্যাংক কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। পরে এনবিআর বা ই-টিআইএন ওয়েবসাইট থেকে ‘রিটার্ন ভেরিফিকেশন’ করেই কর্মকর্তা নিশ্চিত হন ওই রিটার্ন জমা হয়েছে।

অপরদিকে, উত্তরার কাপড় ব্যবসায়ী হোসেন আহমেদ ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে গেলে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখতে চান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। ওই ব্যবসায়ী প্রমাণপত্র দেখান কর্মকর্তাকে। তিনি ই-টিআইএন ওয়েবসাইট থেকে ‘রিটার্ন ভেরিফিকেশন’ করে নিশ্চিত হন ওই ব্যবসায়ী রিটার্ন দাখিল করেছেন। অবসরপ্রাপ্ত সমাজসেবা কর্মকর্তা রবিউল ইসলামের একটি ব্যাংকে প্রায় ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা রয়েছে। সঞ্চয়পত্র ভেঙে টাকা উত্তোলন করতে গেলে ব্যাংক তাকে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে বলেন। প্রমাণপত্র জমা দেয়ার পর ব্যাংকের কর্মকর্তারা ভেরিফিকেশন করে রিটার্ন জমার সত্যতা পান।

আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্যোক্তা কানিজ ফাতেমা, ব্যবসায়ী হোসেন আহমেদ আর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম নয়। যে কারও রিটার্ন সার্কেলে জমা হয়েছে কি নাÑ তিনি নিজে বা যেসব সংস্থা সেবা প্রদান করবে তারা ই-টিআইএন ওয়েবসাইট থেকে ভেরিফিকেশন করে নিতে পারবে। যার ফলে এখন আর কেউ সেবা নিতে গিয়ে ‘ভুয়া রিটার্ন’ জমার প্রমাণপত্র দিলেই ধরা খেয়ে যাবেন। এছাড়া ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে যে কোনো করদাতা রিটার্ন জমা দিয়ে নিশ্চিত হবেন যে, তার রিটার্ন জমা হয়েছে।

 রিটার্ন দাখিলের সত্যতা যাচাই ও সেবা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে এনবিআর ‘রিটার্ন ভেরিফাই’ চালু করেছে।

এনবিআর সূত্রমতে, যেসব সেবার ক্ষেত্রে ই-টিআইএন সনদ বাধ্যতামূলক ছিল, চলতি অর্থবছর (২০২২-২৩) বাজেটে সেসব সেবার ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা বাধ্যতামূলক করা হয়। এর ফলে একদিকে রিটার্ন জমার হার বেড়ে যাবে। অন্যদিকে, করযোগ্য ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান থেকে কর আদায় সহজ হবে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৭৯ লাখ ৬ হাজার ৯২৬ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ই-টিআইএন নিয়েছে। এর মধ্যে গত করবর্ষে (২০২১-২২) রিটার্ন দাখিল হয়েছে ২৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩১৫টি। অর্থাৎ ই-টিআইএন নিবন্ধনধারীর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান রিটার্ন দাখিল করে না।

৪০টি সেবা হলো কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ গ্রহণ; কোম্পানির পরিচালক বা স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার হওয়া; আমদানি-রপ্তানি নিবন্ধন সনদ; সিটি বা পৌরসভা হতে ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন; সমবায় সমিতির নিবন্ধন; সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ার হতে এবং লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন; জমি-ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়; ক্রেডিট কার্ড নেয়া; স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্য হতে; নিকাহ রেজিস্টার লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন; ট্রেড বা পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ পেতে; ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স ও নবায়নে; গ্যাস সংযোগ পেতে; নৌযানের সার্ভে সনদ নিবন্ধন ও নবায়ন; ইটভাটার অনুমতি ও নবায়ন; ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিশু ভর্তি; বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে; কোম্পানির এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ পেতে; আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেতে ও নবায়নে; আমদানির ঋণপত্র খোলা; ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা; ১০ লাখ টাকার বেশি ব্যাংক হিসাব খোলা; পৌরসভা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে; ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনিক অবস্থানে কর্মরত ব্যক্তির বেতন-ভাতা প্রাপ্তিতে; সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ১৬ হাজার টাকা হলে তা প্রাপ্তিতে; বিমা কোম্পানির এজেন্সি সনদ নিবন্ধন ও নবায়নে; যে কোনো সার্ভিস বা জনবল সরবরাহের ক্ষেত্রে কোম্পানি হতে অর্থ প্রাপ্তিতে; মোটরযানের নিবন্ধন ও নবায়ন; এনজিও বা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি হতে বিদেশি অনুদান ছাড়ের ক্ষেত্রে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা বিক্রয়ে; নিবন্ধন কোনো ক্লাবের সদস্য পদ পেতে; পণ্য সরবরাহ, চুক্তি বা সেবা সরবরাহের টেন্ডার ডকুমেন্টস দাখিলের সময়; আমদানি-রপ্তানির বিল অব এন্ট্রি দাখিলে এবং ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনের সময়।

এনবিআরের আয়কর বিভাগ সূত্রমতে, চলতি অর্থবছর ৪০টি সেবার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়। এতদিন এসব সেবা পেতে শুধু ই-টিআইএন সনদ দিলেই হতো। কিন্তু চলতি বছর বাধ্যতামূলক করায় সেবা পেতে অনেকেই ভোগান্তির সম্মুখীন হবেন। বিশেষ করে যারা ই-টিআইএন নিলেও বছরের পর বছর রিটার্ন দাখিল করেন না। অনেকেই রিটার্ন দাখিলের ভুয়া প্রমাণপত্র তৈরি করে সেবা নিতে পারেনÑএমন শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করে এনবিআর। আবার অনেক করদাতা নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করেন। রিটার্ন সার্কেলে সঠিকভাবে জমা রাখা হয় কি নাÑকরদাতার মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। করদাতার শঙ্কা ও সংশয় দূর করতে এবং ভুয়া রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র রোধে এনবিআর চলতি বছর ‘রিটার্ন ভেরিফাই’ চালু করে। এর মাধ্যমে সেবা প্রদানকারী সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এমন কি করদাতা নিজেই রিটার্ন দাখিল হয়েছে কি নাÑতা যাচাই করতে পারবেন।

সূত্র আরও জানায়, এনবিআরের ওয়েবসাইট ও ই-টিআইএন ওয়েবসাইটে ‘ট্যাক্স রিটার্ন ভেরিফিকেশন মডিউল’ নামে এই সিস্টেম চালু করা হয়েছে। যাচাই করতে হলে করদাতাকে ওয়েবসাইটে ‘রিটার্ন ভেরিফাই’ অংশে ক্লিক করতে হবে। সেখানে করবর্ষ ও ই-টিআইএন নম্বর দিতে হবে। ক্যাপচা কোড দিয়ে এন্টার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম ও রিটার্ন জমার করবর্ষ চলে আসবে। তবে করদাতারা এখন ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ (চলতি) করবর্ষের রিটার্ন জমার তথ্য নিশ্চিত হতে পারবেন।

এ বিষয়ে একাধিক কর কমিশনার শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, একজন করদাতা (ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান) সার্কেলে রিটার্ন জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি করা হয়। পরে সার্কেল থেকে ওই ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন জমার তথ্য ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। প্রতিনিয়ত সার্কেল থেকে তথ্য আপলোড করা হচ্ছে। এনবিআরের এই সেবাকে করদাতারা সাধুবাদ জানিয়েছেন। কিছু কিছু সময় রিটার্ন জমা না দিয়েও ভুয়া রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দিয়ে সেবা গ্রহণের তথ্য পাওয়া যেত। এনবিআরের এই পদক্ষেপের ফলে কেউ চেষ্টা করলেও ভুয়া প্রমাণপত্র দিয়ে সেবা নিতে পারবেন না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০