বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি বিষয়ে ডিগ্রি দেওয়া হয় বা ফার্মেসি বিষয়টি পড়ানো হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ষিক কোর্স পদ্ধতি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সেমিস্টার ধরে হিসাব করলে প্রতিবছর প্রায় ছয় হাজার ফার্মাসিস্ট পাস করে বের হন। এখন পর্যন্ত ফার্মাসিস্টদের চাকরির ক্ষেত্র শুধু ওষুধ শিল্পকারখানা বিধায় গড়ে দুই শ’র বেশি চাকরির পদ সৃষ্টি হয় না। তাহলে এসব নবীন ফার্মাসিস্ট কোথায় যাবেন? তাদের চাকরির ক্ষেত্র কোথায়? নবীন ফার্মাসিস্টদের চাকরির একটি বড় ক্ষেত্র হলো রিটেইল, ক্লিনিক্যাল ও হসপিটাল ফার্মেসি, যা পরবর্তী প্রজšে§র ফার্মাসিস্টদের জন্য হতে পারে আকর্ষণীয় ও পছন্দের কর্মক্ষেত্র।
রিটেইল, ক্লিনিক্যাল ও হসপিটাল ফার্মেসি কী? এগুলো কীভাবে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে হয়? ফার্মাসিস্ট কীভাবে সেখানে চিকিৎসা ও ফার্মেসিসেবা দেবেন? রোগীর সঙ্গে একজন ফার্মাসিস্ট কেমন আচরণ করবেন? কেমন স্থানে এগুলো স্থাপন করতে হয়? কী পরিমাণ মূলধন লাগে? আবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কীভাবে এগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যায় এসব বিষয় এখানে আলোচনা করা হবে।
সেই অর্থে নবীন ফার্মাসিস্টদের চাকরির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে পর্ব আকারে এ লেখা হবে। আশা করি লেখাগুলো যাদের জন্য লেখা তারা বিবেচনায় নেবেন এবং এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে জনসেবায়, মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করার সুযোগ করে দেবেন।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে ফার্মেসি শিক্ষা ও পেশার অবস্থানটা জেনে নিই এবং ফার্মাসিস্টদের প্রাণের দাবিগুলো সম্পর্কে অবগত হই।
স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানে ফার্মেসির অবস্থান কোথায়?
ফিজিওলজি, প্যাথলজি ও ফার্মাকোলজির আন্তসম্পর্ক অনুসারে ফার্মেসি হলো মূল বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার জিএমপির গাইডলাইনে মূল বিষয় হিসেবে ফার্মেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে
PHARMACY is the study of an Òappropriate combinationÓ of –
(a) Chemistry (analytical or organic) or biochemistry
(b) Chemical engineering
(c) Microbiology
(d) Pharmaceutical sciences and technology
(e) Pharmacology and toxicology
(f) Physiology and other related sciences.
এখানে the study of an appropriate combination
আলাদাভাবে যে কেউ উল্লিখিত বিষয়ে পড়লে নিজের ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি হবেন, কিন্তু
ফার্মাসিস্ট হবেন না।
ফার্মাসিস্ট হতে হলে উল্লিখিত বিষয়গুলোর যথাযথ কম্বিনেশন বা সমম্বয় লাগবে। সেই কারণে ফার্মেসি একটি অনন্য বিষয় এবং পেশা হিসেবেও অনন্য। হেলথ সায়েন্স বা মেডিক্যাল সায়েন্সের সঙ্গে এর তুলনা হয় না।
সেই জন্যই ওষুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে রিটেইল ফার্মেসি বা হসপিটাল ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট থাকা অপরিহার্য।
স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসাসেবা খাতে ফার্মাসিস্টের অবস্থান কোথায়?
ফার্মাসিস্টরা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডায়াগ্রাম অনুসারে, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ফার্মাসিস্টরা অবিচ্ছেদ্য অংশ কিন্তু আমাদের দেশে বাস্তব অবস্থা পুরোপুরি ভিন্ন। স্বাস্থ্যসেবা টিম ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, নার্স ও স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিবিদ এ চার শ্রেণির স্বাস্থ্য পেশাজীবী নিয়ে গঠিত হয়। আমাদের দেশে ফার্মাসিস্টদের অবস্থান কোথায়?
আশা করি আমাদের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়গুলো সম্যক অনুধাবন করবেন এবং ফার্মাসিস্টদের
কিছু দাবি সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবেন।
স্বাস্থ্যসেবা খাত ও স্বাস্থ্যসেবা টিমে ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা পালন নিশ্চিত করতে ফার্মাসিস্টদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য ফার্মাসিস্টদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের ফার্মাসিস্টদের দাবিগুলো নিন্মরূপ
এক. পদোন্নতির সুবিধা রেখে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) কর্তৃক ফার্মেসিকে ‘ক্যাডার বিষয়’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। পদের নাম হবে ‘ফার্মাসিউটিক্যাল অফিসার’। সরকারি হাসপাতালগুলোয় ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ হিসেবে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাবেন তারা।
দুই. বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, সেনাবাহিনী, ব্যাংক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দিতে হবে।
তিন. সারা দেশে হসপিটাল ও কমিউনিটি ফার্মেসি চালু করতে হবে এবং এসব ফার্মেসিতে ‘এ’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে।
চার. ‘ড্রাগ ও থেরাপিউটিক কমিটি’ গঠন করে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় ফার্মাসিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পাঁচ. ফার্মেসি একটি পেশাগত বিষয় এবং ওষুধ মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে জড়িত। তাই এ পেশা ও পেশাজীবীদের সম্মান রক্ষার্থে যেসব শিক্ষার্থী ফার্মেসি পড়তে ইচ্ছুক, তাদের জন্য মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার অনুরূপ একটি ‘কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করার ক্ষমতা বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলকে (পিসিবি) দিতে হবে। সেই পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা তাদের মেধাক্রম অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হবে।
ছয়. স্বাস্থ্য ও ফার্মেসি সেবাদানের সুযোগগুলোকে যথাযথভাবে নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্যসেবার সব খাতে পেশাগত ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দিতে হবে।
রিটেইল ও হসপিটাল ফার্মেসি: পরবর্তী প্রজন্মের ফার্মাসিস্টদের পছন্দের কর্মক্ষেত্র
আমাদের দেশে ওষুধের দোকান কীভাবে পরিচালিত হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পাঠ্যক্রম নেই। ইন্ডিয়ার ডিপ্লোমা ফার্মেসি ও আমাদের দেশের ‘সি গ্রেড’ ফার্মেসির সিলেবাসের আলোকে রিটেইল ফার্মেসির ওপর ধারাবাহিক আলোচনা শুরু করছি।
ক. ওষুধের দোকান ব্যবস্থাপনা
রিটেইল ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান
বলতে কী বোঝায়?
বাংলাদেশে সত্যিকারের কোনো কমিউনিটি ফার্মেসি নেই। কমিউনিটি ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা ও সেবাদানের যেসব শর্ত আছে, বাংলাদেশে তার বেশিরভাগই পূরণ করা হয় না। তাই রিটেইল ফার্মেসি বা খুচরা ওষুধের দোকানই একমাত্র ভরসা।
আমাদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবস্থাপনায় সব নাগারিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সমন্বিত ফার্মেসি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যে ওষুধীয় সেবা পরিবেশন করে থাকে, তাকে রিটেইল ফার্মেসি বলে। আমাদের দেশে ড্রাগ স্টোর বা মেডিসিন শপের মাধ্যমে রিটেইল ফার্মেসি ব্যবস্থা কাজ করে থাকে।
এ সমন্বিত ব্যবস্থাটি হলোঃ সমাজের সব ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ, বিতরণ ও ওষুধ-সম্পর্কিত সব তথ্য দেওয়া। সহজভাবে বলা যেতে পারে, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় যেখান থেকে ওষুধ ও ওষুধ-সম্পর্কিত তথ্য অতি সহজে পাওয়া যায়, তাকে রিটেইল ফার্মেসি বলে। আর ড্রাগ স্টোর বা মেডিসিন শপ অর্থাৎ ওষুধের দোকানই হলো এই বহুল কথিত রিটেইল ফার্মেসি। আমাদের মনে রাখতে হবে, রিটেইল ফার্মেসি, যেটিকে আমরা ড্রাগ স্টোর বা মেডিসিন শপ বলি, তা শুধু একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানই নয়, এটি একটি সেবাদান কেন্দ্রও বটে।
আমাদের দেশে রিটেইল ফার্মেসি ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান কোনো নির্দিষ্ট এলাকার প্রয়োজনীয় সব ওষুধের চাহিদা পূরণ করে থাকে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে একদিন সঠিকভাবে রিটেইল ফার্মেসি সেবা চালু হবে, সেটা আমরা আশা করতে পারি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে চেইন ফার্মেসিরও প্রচলন হচ্ছে। চেইন ফার্মেসি মূলত রিটেইল ফার্মেসি, যা একক ও কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধানে অনেকগুলো ফার্মেসির ব্যবস্থাপনা একক নামে বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হয়। যথা ‘লাজ ফার্মা, কিউপিএস (কুইক প্রিসক্রিপশন সার্ভিস) প্রভৃতি।
রিটেইল ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানের
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
সমাজে রিটেইল ফার্মেসি প্রতিষ্ঠার চারটি উদ্দেশ্য থাকে। এগুলো হলোঃ
এক. কোনো নির্দিষ্ট এলাকার সব ব্যক্তি ও পরিবারের স্বাস্থ্য ও রোগের প্রতি দৃষ্টি রেখে উপশম, প্রতিষেধক, স্বাস্থ্য সংরক্ষণ এবং রোগীর স্বাস্থ্য পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ফার্মেসিসেবার ব্যবস্থা করা।
দুই. এলাকার সব স্বাস্থ্যবান ও অসুস্থ
জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় ফার্মেসিসেবার (ফার্মেসি সার্ভিস) ব্যবস্থা করা।
তিন. এলাকার সব ব্যক্তির স্বাস্থ্য সমস্যা ও চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে ফার্মেসিসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
চার. ফার্মেসিসেবার সুযোগগুলো সেই এলাকার অন্য পেশার ব্যক্তিরা (চিকিৎসক, নার্স, রোগী বা রোগীর সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি, স্বাস্থ্যকর্মী, এনজিও কর্মী, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, সমাজসেবক, কৃষিবিদ, মনোবিজ্ঞানী প্রভৃতি), যারা জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের কাজ করছেন বা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য ও তথ্য সরবরাহ করা।
রিটেইল ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা পদ্ধতি
রিটেইল ফার্মেসির ব্যবসা একজন রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্টের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়া উচিত। রিটেইল ফার্মেসি ব্যবসা শুরু করার জন্য বৈধ ড্রাগ লাইসেন্স থাকতে হয়। ড্রাগ লাইসেন্স ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের (পরের কোনো এক পর্বে এটা নিয়ে লিখব) অফিস হতে ইস্যু করা হয়ে থাকে। ড্রাগ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে আটটি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়।
এগুলো হলো
এক. ট্রেড লাইসেন্স।
দুই. ব্যাংক সচ্ছলতা সনদপত্র।
তিন. দোকান ভাড়ার রসিদ/চুক্তিনামা/নিজস্ব দোকানের ক্ষেত্রে মালিকানা দলিলের সত্যায়িত ফটোকপি।
চার. ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদপত্রের সত্যায়িত কপি।
পাঁচ. নাগরিকত্ব বা ভোটার ন্যাশনাল আইডি. কার্ডের সত্যায়িত কপি।
ছয়. ফার্মাসিস্টের অঙ্গীকারপত্রের মূল কপি।
সাত. পূরণ করা ফরম- ৭।
আট. ট্রেজারি চালানের মূল কপি।
Add Comment