শওকত আলী: বিভিন্ন সময় দেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক জব্দ বা বাজেয়াপ্ত হওয়া ভারতীয় ৫০০ ও ১০০০ রুপি নোট নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই দ্রুত এ নোটগুলো পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) গভর্নরকে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ভারত সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাতিল হয়ে যাওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট কোনো কর্তন ছাড়া পরিবর্তন করা যাবে। তাই দ্রুত ওই রুপিগুলো পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গতকাল বুধবার আরবিআই’র গভর্নর বরাবর চিঠি দিয়েছেন ফজলে কবির। জব্দ হওয়া রুপি এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় থাকা রুপিগুলোর বিনিময়ে হস্তক্ষেপ চেয়ে এ চিঠি প্রদান করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেরিতে হলেও জব্দ রুপি পরিবর্তনে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চাওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে অবৈধভাবে প্রবেশের সময় আটক রুপিগুলো পরিবর্তনে ভারত সরকার কতটা আন্তরিকÑতা নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে। তাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধভাবে আটক রুপিগুলো বিনিময় করা গেলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। তাই এটা বিনিময়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এটা পরিবর্তন করা না গেলেও বাংলাদেশের ক্ষতির কিছু নেই।
জাল ও কালোটাকার বিস্তার রোধ এবং দুর্নীতি ঠেকাতে গত ৮ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিলের ঘোষণা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঘোষণা অনুযায়ী, ১০ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পোস্ট অফিস ও ব্যাংকে গিয়ে এসব মূল্যমানের রুপির নোট পরিবর্তন করা যাবে। যারা এ সময়ের মধ্যে বিশেষ কোনো কারণে পুরোনো নোট জমা দিতে পারবেন না, তারা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এসব নোট জমা দিতে পারবেন। ভারত সরকারের ঘোষণার পর থেকে দেশের কোথাও চলছে না ভারতীয় ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট। এতে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশের মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ব্যক্তি পর্যায়ে রুপির গ্রাহকরাও। কারণ পাসপোর্টে রুপি এনডোর্স করা হয় না, তাই যাদের কাছে এ রুপি আছে, তার কোনো নথিভুক্ত রেকর্ড নেই। তাই দেশের অভ্যন্তরে বৈধভাবে এ নোট চালানোর কোনো সুযোগও নেই। তাছাড়া ডলার, ইউরো ও পাউন্ডের মতো ভারতীয় রুপি প্রচলনযোগ্য মুদ্রা নয়। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও এ বিষয়ে কোনো দায় নেবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থিত স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াও এর দায় নিতে অস্বীকার করেছে।
তবে মানি চেঞ্জার ও ব্যক্তি পর্যায়ে থাকা রুপির দায় না নিলেও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় থাকা রুপিগুলো বিনিময়ের বিষয়ে গত ১০ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের কলকাতা শাখাকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা বিনিময় করে নেওয়ার বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পায়নি ওই শাখাটি। অন্যদিকে, নোট পরিবর্তন করে নেওয়ার বেঁধে দেওয়া সময়ও শেষ হতে চলেছে। এতে রুপিগ্রহীতা ব্যাংকগুলোও চিন্তিত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনরায় হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত ৮ নভেম্বর ভারত সরকার ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল ঘোষণা করলেও জব্দ রুপির বিষয়ে শুরুতে অন্ধকারে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের হাতে থাকা রুপিগুলোর কী হবে জানতে চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দেওয়ার পর এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা অফিসের পাশাপাশি এনবিআরের সব কাস্টমস কমিশনারেট থেকে আটক ও জব্দ রুপির তথ্য সংগ্রহ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে তা সমন্বয় করে মঙ্গলবার অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং এনবিআরকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে এসব রুপি বিনিময়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যা বুধবার পাঠানো হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজি হাসান বলেন, বিভিন্ন সময় জব্দ এবং বাজেয়াপ্ত ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোটগুলো বিনিময়ের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের কলকাতা শাখার মাধ্যমে এগুলো পরিবর্তনের বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে।
বিভিন্ন সময় দেশের বিমানবন্দর, নদীবন্দর ও সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতীয় রুপিসহ অন্যান্য মুদ্রা অবৈধভাবে দেশের মধ্যে ঢোকানোর চেষ্টা করেন বিদেশিদের পাশাপাশি দেশের অসাধু নাগরিকরা। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক এসব রুপি আদালতের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রাখা হয়। যেগুলোর মালিক জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বা সরকার। তবে স্থায়ী ও অস্থায়ী খাত মিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঠিক কি পরিমাণ ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট রয়েছে, সেটি নির্দিষ্ট করে বলতে রাজি হচ্ছেন না নীতিনির্ধারকদের কেউই।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, এর পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি। তবে তা ১০০ কোটি টাকার কম। জানা গেছে, বিভিন্ন কাস্টম অফিস থেকে এখনও আটক ভারতীয় রুপির তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা অফিসে জমা রাখা রুপিগুলোও কাস্টম কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করছে। যাতে তা টাকা বা ডলারে রূপান্তর করে রাখা যায়। গত রোববার সিলেট কাস্টমস কমিশনারেট অফিস বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখার নির্বাহী পরিচালক বরাবর ই-মেইলে তাদের মাধ্যমে আটক হওয়া এক কোটি ১৫ লাখ রুপির নোটের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে। ওই ই-মেইলে বলা হয়, ওসমানী বিমানবন্দর কাস্টম কর্তৃপক্ষ এক কোটি ১৫ লাখ কথিত ভারতীয় রুপি আটকের পর ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর সিলেট বাংলাদেশ ব্যাংক শাখায় জমা করে। যার রশিদ নং-এসডি-১৭৫/২০১৪। যেহেতু ভারত সরকার ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করেছে, তাই এই রুপিগুলো ভারতীয় রুপির পরিবর্তে মার্কিন ডলার অথবা বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তর করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ভারত সরকারের নোট বাতিলের ঘোষণার পর গত ৯ নভেম্বর দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ভারতীয় রুপি থাকার তথ্য চায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন মূল্যমানের ১২ লাখ ভারতীয় রুপি রয়েছে। যার মধ্যে ৫০০ ও ১০০০ মূল্যমানের রুপি রয়েছে ১১ লাখ। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের কাছেই আছে চার লাখ রুপি। এছাড়া অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের কাছে আছে তিন লাখ রুপি করে। বাকি এক লাখ আছে জনতা ব্যাংকের কাছে। এসব রুপি সোনালী ব্যাংকের কলকাতা শাখার মাধ্যমে এক্সচেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ থেকে সোনালী ব্যাংককে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক তাদের কাছে থাকা রুপি সোনালী ব্যাংকের কাছে জমা করে। এরপর সোনালী ব্যাংকের কলকাতা শাখার মাধ্যমে এই অর্থ এক্সচেঞ্জ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভারতের পক্ষ থেকে তা বিনিময় করা হবে কি না, সে বিষয়ে কোনো সাড়া আসেনি।