হাঁস-মুরগি, জৈব সার, মাছ ও কৃষি উদ্যান তৈরি করে সাফল্য পেয়েছেন নাটোরের নারী উদ্যোক্তা রুবাইয়া রহমান রুবিনা। এজন্য ছয় বছরে পেয়েছেন একাধিক স্বীকৃতি। রুবিনা এখন নারী উদ্যোক্তার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করছেন।
অভাব-অনটনের সংসারে বাবার মৃত্যু আর বিয়ের পর নিজের সংসার ভেঙে যায় রুবিনা। তবে দমে যাননি তিনি, ভেঙে পড়েননি। নাটোর শহরের গ্রামে বাবার অবর্তমানে মা আর ছোট ভাইবোনের সংসারের হাল ধরেন রুবিনা। সেলাই করে সংগৃহীত অর্থ ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ির আঙিনায় ৫০০ বাচ্চা নিয়ে ব্রয়লার মুরগির খামার শুরু করেন। সেখানেও দুর্ভাগ্যের শিকার হন। মুরগি বিক্রি করে ক্ষতির সম্মুখীন হন।
কিন্তু হার মানার পাত্রী নন রুবিনা। তার ভাষায়, ব্যবসায়ে লোকসানের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মুনাফা। তাই নতুন উদ্যমে শুরু করেন খামারের কার্যক্রম। শুধু মুরগির খামারই নয়, বাড়িসংলগ্ন পুকুরে শুরু করেন মাছ চাষ, সঙ্গে ৩০০ হাঁসের সমন্বয়ে খামার।
স্থানীয় অনেক উদ্যোক্তার কাছে অফুরান জীবনীশক্তির অধিকারী রুবিনা। প্রায় একই সঙ্গে মাছ আর হাঁস-মুরগির খামারের পাশাপাশি কৃষিকাজও শুরু করেন তিনি। পর্যায়ক্রমে জমি ইজারা নিয়ে ফলের ছয়টি বাগান তৈরি করেন। এসব বাগানে ফলছে আম, লেবু, পেয়ারা, কলা, কুল ও পেঁপে। রয়েছে মরিচও। আমের তালিকায় রয়েছে অপ্রচলিত ও আদরণীয় গৌরমতি এবং ব্যানানা ম্যাঙ্গোর মতো আম। নাটোর হর্টিকালচার সেন্টার ড্রাগনের ৪০টি খুঁটিতে ১২০টি ড্রাগনের প্রদর্শনী খামার তৈরি করে দিয়েছে রুবিনাকে। আশা করা যায়, এ বছরেই ফল পাওয়া যাবে। ড্রাগনের বাগানে সাথি ফসল হিসেবে রুবিনা চাষ করেছেন মৌসুমি সবজি।
সব উপকরণের কার্যকর ব্যবহার করে রুবিনা প্রমাণ করেছেন, কোনো কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে তৈরি করছেন উৎকৃষ্ট জৈব সার-রিং কম্পোস্ট। প্রতি মাসে এর বিক্রয় মূল্য অন্তত তিন হাজার টাকা। পাশে উৎপাদন করছেন আরও একটি জৈব সারÑভার্মি কম্পোস্ট। বাড়ির শোভা বাড়িয়ে রেখেছে এক ঝাঁক কবুতর। এর বাণিজ্যিক দামও কম নয়।

রুবিনার বিশাল এ কর্মযজ্ঞে সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছেন ছোট ভাই রুবেল আর ছোট বোন রিমিকে। প্রতিদিন গড়ে ২০ শ্রমিক কাজ করে তার খামারে।
রুবিনার কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতি দিয়েছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর। তার আঙিনায় আইপিএম স্কুল পরিচালনা করে এলাকার ২৫ পরিবারের ৫০ সদস্যকে হাঁস-মুরগি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, সবজি চাষ, বসতবাড়ির বাগান প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা করেছে নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। রুবিনার নেতৃত্বে গঠিত চাঁদপুর নারী উন্নয়ন সমবায় সমিতির ৫০ সদস্য প্রশিক্ষণ শেষে সবাই সমবায় বিভাগ থেকে মাত্র দুই শতাংশ সার্ভিস চার্জে গাভী পালনের ঋণ পাচ্ছেন এক লাখ ২০ হাজার টাকা করে। ১০০ সদস্যের অন্যরা পর্যায়ক্রমে ঋণের অপেক্ষায় রয়েছেন। রুবিনার গাভী খামার শিগগির উৎপাদনে আসবে। সবার উৎপাদন নিয়ে এ এলাকায় তিনি গড়ে তুলতে চান মিল্কভিটা বা প্রাণের দুগ্ধ ক্রয় কেন্দ্র।
নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের অধীন ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় রুবিনাকে কমিউনিটি হর্টিকালচার প্রোভাইডার মনোনীত করা হয়েছে। কৃষিতে উদ্যোক্তা সৃষ্টির কাজ করছেন তিনি। এলাকার আট শতাধিক ব্যক্তিকে হর্টিকালচার সেন্টারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়াও প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও হাতে-কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। প্রশিক্ষণ শেষে হর্টিকালচার সেন্টারের গাছ, সার আর উপকরণ সহায়তায় গড়ে উঠেছে ৫০ ফলের বাগান আর ৩৫ বাড়ির বাগান। ইতোমধ্যে তার হাতে তৈরি নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে সফল হয়েছেন হেনা বেগম, শাকিলাসহ বেশ কয়েকজন। হেনা বেগম বলেন, আমাদের নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছেন রুবিনা। রুবিনা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে গত বছর নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কসহ গ্রামীণ সড়কের দুই কিলোমিটার স্থানজুড়ে তালের গাছ লাগিয়েছেন। এবার নারকেলের চারা রোপণের পরিকল্পনা করেছেন।
নাটোর মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর রুবিনাকে দিয়েছে জয়িতা পদক। ইউনিলিভার ‘তোমার স্বপ্ন কর সত্যি’ ক্যাটেগরিতে তিনি দুই লাখ টাকার প্রাইজমানি পেয়েছেন। ২০১৮ সালে রাজধানীর খামারবাড়ীতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের আয়োজনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে ‘কৃষি উন্নয়নে নারী’ পদক পেয়েছেন রুবিনা।
রুবিনা বলেন, আমার এ পথ চলাতেই আনন্দ। আমার পথচলা সার্থক হবে, যদি আমি সমাজের অবহেলিত নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আমাদের এলাকায় কৃষির মাধ্যমে সবুজ বিপ্লব ও গাভীর মাধ্যমে শ্বেতবিপ্লব ঘটাতে চাই।
নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার বলেন, রুবিনাকে কমিউনিটি হর্টিকালচার প্রোভাইডার মনোনীত করার পর তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। নতুন উদ্যোক্তা বিশেষত নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে তিনি সফল।
মেধা আর কৃষি বিভাগের প্রয়োজনীয় সমর্থন ও সহযোগিতায় রুবিনা এখন সফল উদ্যোক্তা। সারা দেশে রুবিনার মতো উদ্যোক্তা তৈরি হলে দেশ হবে সমৃদ্ধ।
তাপস কুমার, নাটোর