ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহঃ ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের অফিসসজ্জায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ কোটি টাকা। ঢাকা-মাওয়া চার লেন নির্মাণ প্রকল্পে এ ব্যয় পাঁচ কোটি টাকা। চলমান অন্য প্রকল্পের পরিচালকদের অফিসসজ্জার ব্যয় এর অনেক নিচে। যদিও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ (মূল পর্যায়) প্রকল্পে অফিসসজ্জা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ খাতে প্রস্তাবিত বিভিন্ন অফিস সরঞ্জাম কেনায় ব্যয়ও ধরা হয়েছে অস্বাভাবিক বেশি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য পাবনার রূপপুরে প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থাকবে; যা সজ্জিত হবে পরিপাটিভাবে। আসবাব ছাড়াও কেনা হবে টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, ফটোকপিয়ার, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট মডেম, টেলিফোন ইত্যাদি। এর মধ্যে আসবাব বাবদ ব্যয় হবে ৫৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। আর কম্পিউটার, সফটওয়্যার ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনায় ব্যয় হবে ১১১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রকল্প পরিচালকের অফিসসজ্জায় ব্যয় হবে ১৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা এমনটাই বলা হয়েছে প্রকল্পটির ব্যয় বিশ্লেষণে।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, বর্তমানে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে পরিচালকের অফিসসজ্জায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণে। ঢাকা ও মাওয়ায় দুই অফিস মিলিয়ে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ কোটি টাকা। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন প্রকল্প পরিচালকের অফিসসজ্জায় ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রকল্প পরিচালকের অফিসসজ্জায় ব্যয় ধরা আছে দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা।
প্রস্তাবিত কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে প্রকল্প পরিচালকের অফিসসজ্জায় ব্যয় ধরা হয়েছে দুই কোটি ৩৪ লাখ টাকা। দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে এ খাতে ব্যয় এক কোটি ৩১ লাখ টাকা। এছাড়া উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রস্তাবিত মেট্রোরেল নির্মাণে অফিসসজ্জায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭ লাখ টাকা। শেষ হতে চলা ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি অফিসসজ্জায় ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৫ লাখ টাকা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকল্প পরিচালকের জন্য শুধু আসবাবই কেনা হবে ১৯ কোটি ৩২ লাখ টাকার। এর মধ্যে রয়েছে, টেবিল, চেয়ার, ডেস্ক, আলমারি, সেলফ, ফাইল ক্যাবিনেট, সোফা, কার্পেট ও অন্যান্য আসবাব। অন্যান্য সরঞ্জাম কেনায় ব্যয় হবে আরও ৩৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ফটোকপিয়ার, টেলিভিশন, ফ্রিজ, মাইক্রো ওভেন, কফিমেকার, এসি, ফ্যাক্স, মেটাল ডিটেক্টর, ব্যাগ স্ক্যানার প্রভৃতি। এসব আসবাব ও সরঞ্জাম ছাড়াও কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনায় ব্যয় হবে ৯৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আর সফটওয়্যার, এন্টিভাইরাস, ফায়ারওয়াল ও অন্যান্য প্রোগ্রাম কেনায় ব্যয় হবে ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (প্রাথমিক পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর শেয়ার বিজকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাবে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল। এগুলোর যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করা হয়েছে। সব দিক বিবেচনা করেই এসব খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখন আর এসব ব্যয়ে কোনো ধরনের সমস্যা নেই।
জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গাড়ি কেনায়ও বিলাসিতা করা হয়েছে। প্রকল্পের জন্য ১০২টি গাড়ি ও অন্যান্য যান কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এছাড়া চারটি স্পিডবোট কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। গাড়ি মেরামতে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় কোটি টাকা। আর কম্পিউটার ও অফিস সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ১০ কোটি টাকা। এছাড়া কাঠের আসবাব রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হবে এক কোটি টাকা। অফিস ভবন রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হবে ৪০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় ৮০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, প্রকল্পটির বিভিন্ন খাতের ব্যয় সামঞ্জস্যহীন ও অনিয়ন্ত্রিত। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একনেকে অনুমোদনের আগেই এগুলো কাটছাঁট করা উচিত ছিল। এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্যতা যাচাই স্পষ্ট নয়, ইআইএ নিয়ে লুকোচুরি, স্পেন্ট ফুয়েল (অবশিষ্ট তেজস্ক্রিয় জ্বালানি) ইস্যুর সমাধান হয়নি। এরই মধ্যে প্রকল্পটির অনুমোদন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ (মূল পর্যায়) প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। ৯ বছর মেয়াদি প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। রাশিয়ান ফেডারেশনের স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট হিসেবে দেবে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ২২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা দেওয়া হবে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। এর মধ্যে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ব্যয় নিয়ে আপত্তি তুলেছিল পরিকল্পনা কমিশন।
এর মধ্যে প্রকল্পের বেতন-ভাতায় ৭০০ কোটি টাকা, যানবাহন কেনায় ৬৫ কোটি টাকা, সরঞ্জাম কেনায় ২৯২ কোটি টাকা, কম্পিউটার ও সফটওয়্যারে ১১১ কোটি টাকা, টেলিযোগাযোগ সরঞ্জামাদি সংগ্রহে ১৪০ কোটি টাকা, ভূমি অধিগ্রহণে তিন হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, পরামর্শক প্রশিক্ষণ ও সেবা খাতের দুই হাজার ৯৯২ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন বেশি করা হয়েছে। এ বিষয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যাও দাবি করা হয়।
Add Comment