রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘সোনার বাংলা’। অথচ আমরা অনেকেই না জেনে, না বুঝে, না দেখেই বলি এই দেশ অতটা সুন্দর নয়। এর চেয়ে অন্য কোনো দেশ সুন্দর। এমন মন্তব্য করার আগে দেশটা ভালো করে দেখা উচিত নয় কি? আমাদের দেশে মনোমুগ্ধকর অনেক জায়গা আছে, যা নেই অনেক দেশে, যেমনটা রবীন্দ্রনাথই তার অন্য কবিতায় বলেছেন, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া…।’
নিজ দেশের তেমন কিছু সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান দেখে এলাম সেদিন। ঘুরে এলাম রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ফরিদপুর থেকে সোজা রাঙামাটির পথে, এরপর অন্য জায়গায়। ভাড়া করা গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম জীবনসঙ্গীর সঙ্গে। বিকাল ৫টায় রওনা দিয়ে পরদিন বেলা ১১টায় পৌঁছলাম রাঙামাটি। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম কাপ্তাই লেকের উদ্দেশে। পানির রং যে আকাশের মতো হয় এখানে না এলে বোঝা সম্ভব নয়। লেকের দৃশ্য দেখে পথের সব ক্লান্তি এক নিমিষেই যে দূর হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। লেকে ভ্রমণ করতে করতে চলে গেলাম সুভলং ঝরনায়। আমরা গিয়েছি ডিসেম্বরে, তাই ঝরনা দেখতে পেলাম না। কিন্তু পাথুরে পাহাড়ের গায়ে প্রাকৃতিক কারুকাজ চোখ ঠাণ্ডা করে দিচ্ছিল। চারপাশে পাহাড় গোটা লেকটাকে ঘিরে রেখেছে। মাঝে মাঝে কিছু পাহাড়ও আছে। নাম না জানা গাছে পাহাড়গুলো আবৃত। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ক্লান্ত হয়ে চলে গেলাম পেদা টিং টিং রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। দ্বিগুণ দামে পানি কিনে, তৃষ্ণা মেটাই। অনেকে লেকের পানিই পান করেছেন।
আমাদের ট্রলার এবার চলল ঝুলন্ত সেতুর দিকে। ঝুলন্ত সেতু পৃথিবীতে অনেক জায়গায় আছে, কিন্তু এমন মনোমুগ্ধকর সেতু হয়তো আর কোথাও নেই। দুই পাহাড়ের পাদদেশে সেতু অবস্থিত। এলাকার উপজাতিরা পাহাড়ি কলা, আখ, জাম্বুরা প্রভৃতির পসরা সাজিয়ে বসেছে। সন্ধ্যার সৌন্দর্য উপভোগ করে সেখান থেকে ফিরে এলাম পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আমাদের হোটেলে।
হোটেল গ্রিন হিল। বেশ ভালোই। হোটেলের বাবুর্চির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম তার বাড়িও ফরিদপুরের টেপাখোলায়। একই এলাকার হওয়ায় খাওয়ালোও বেশ। রাতে ঘুমানোর আগে সিদ্ধান্ত হলো সকাল ৬টায় বান্দরবান যাব। রাতে আরামের ঘুম শেষে সকালে তড়িঘড়ি উঠে প্রস্তুতি নিয়ে ৬টা ৩০ মিনিটে আমাদের গাড়ি বান্দরবানের উদ্দেশে রওনা হলো। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। কোথাও বেশ উঁচু, আবার কোথাও নিচু। ড্রাইভারকে ১ নম্বর গিয়ারে ফেলে ওপরে উঠতে হচ্ছিল। আঁকাবাঁকা পথে ভ্রমণ যেমন ছিল কষ্টকর, তেমনই ছিল আনন্দদায়ক। ফেরিঘাটে বেশ ক্ষাণিকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। হঠাৎ দেখি কর্ণফুলী নদীতে সাম্পান নৌকা। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওপার যাওয়ার ভাড়া কত? তিনি বললেন, পাঁচ টাকা। ঝটপট উঠে পড়লাম। কর্ণফুলী নদীতে একটা রাইড হয়ে গেল। ইতোমধ্যে গাড়ি ফেরিতে পার হয়ে এলো। আবার রওনা। পথিমধ্যে মাঝেমধ্যেই চেকপোস্ট। নিয়মকানুন সারা হলে আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করে। আঁকাবাঁকা পথ এবার যেন একটু বাড়ল। হঠাৎ একটা পাহাড়ের কাছে এসে আমাদের গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার বলল, আমরা এসে গেছি স্বর্ণমন্দিরে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা ছুটলাম স্বর্ণমন্দিরের উদ্দেশে। প্রায় দুইশ থেকে তিনশ ফুট পাহাড় বেয়ে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে অবস্থা কাহিল। টিকিট মাত্র ৩০ টাকা। ঝটপট টিকিট নিয়ে ভেতরে ঢুকে মন ভরে গেল। পাহাড়ের চূড়ায় সোনা রঙের স্বর্ণমন্দির। সবটাই সোনালি রঙের। সোনালি ড্রাগন, মূর্তি প্রভৃতি। নিচে চরাচর। অনেক ছবি তুললাম। ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম আমরা। প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আবার আমাদের গাড়ি চলল বান্দরবান শহরের দিকে। মিনিট দশেক চলার পরে গাড়ি বান্দরবান শহরে পৌঁছে গেল।
গাড়ি থেকে নেমে এবার চাঁদের গাড়ির খোঁজ শুরু হলো। আমরা যাব নীলগিরিতে প্রায় তিন হাজার ফুট ওপরে। সেখানে আমাদের গাড়ি যেতে পারবে না। নীলগিরি যাওয়ার জন্য চাঁদের গাড়িতে চেপে যেতে হয়। প্রতি গাড়ির ভাড়া চার হাজার ২০০ টাকা। দুপুর সাড়ে ১২টায় আমাদের চাঁদের গাড়ি চলতে শুরু করল। চাঁদের গাড়ির রাইড ছিল রোমাঞ্চকর। অনেকটা রোলার কোস্টারে চড়ার মতো। ডানে-বামে অসংখ্য পাহাড় আর ঘন বাঁক। আমরা উঠছি তো উঠছিই। অন্য পাহাড়গুলো এবার ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। বাড়িঘর-মানুষজন তো দূরের কথা, পাহাড়গুলোই ছোট দেখাচ্ছিল। মাঝে মাঝে পাহাড়ের মধ্যে নীল রঙের নদী দেখতে পাচ্ছিলাম। এমন দৃশ্য যে চোখই সরাতে পারছিলাম না। কী দেখছি! পৃথিবী কত সুন্দর। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের এমন সুন্দর একটি জায়গায় জš§ দিয়েছেন বলে তাকে ধন্যবাদ জানালাম মনে মনে। ঘণ্টা দেড়েক পর গাড়ি থামল। আমরা এসে গেছি চিম্বুক পাহাড়ে। রাস্তা এমনিতেই পাহাড়ের ওপরে ছিল। তারপরও চিম্বুকের সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে চাইলাম। চূড়ায় উঠে নিচের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম কারণটা কী? নিচ থেকে চূড়াটা খুব বেশি উঁচু দেখায়নি। কিন্তু ওপর থেকে বুঝলাম বেশ উঁচু, প্রায় দুইশ ফুট হবে। চিম্বুকের চূড়ায় দেখলাম বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ডের একটি স্টেশন রয়েছে। সেখানে কিছু বাঙালি অফিসার বাস করেন। আমাদের দেখে তারা জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছি। আমরা বললাম, ফরিদপুর থেকে। আমাদের খুব সাদরে তারা আমন্ত্রণ জানালেন। চিম্বুকের চূড়ায় বাগান থেকে পাহাড়ি জলপাই খাওয়ালেন।
পাহাড় থেকে নেমে আবার গাড়িতে উঠলাম। পথে আবার একবার থেমে পাহাড়ি পেঁপে খেলাম। পাহাড়ি পেঁপে বেশ মিষ্টি। খাওয়া শেষে আবার যেতে শুরু করলাম। যতই সামনে এগোচ্ছি ঠাণ্ডাটা যেন হিম হতে শুরু করেছে। তাই গরম পোশাকটা পরে নিলাম। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিশাল উচ্চতার সেই নীলগিরীতে পৌঁছলাম। কী দৃশ্য! মনে হচ্ছে একটা উপগ্রহ থেকে বুঝি পৃথিবীকে দেখছি! জায়গাটায় খুব সুন্দর ও পরিষ্কার করে কতগুলো কটেজ তৈরি করা হয়েছে। সুন্দর স্পটগুলোয় স্টিলের রেলিং দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ফুলের বাগান করা হয়েছে। চমৎকার জায়গা। দূরে মেঘ দেখা যাচ্ছে যা আমাদের থেকে নিচে মানে আমরা মেঘের ওপরে চলে এসেছি। সাদা মেঘের গুচ্ছ দেখার জন্য ওপরে তাকাতে হয় না, নিচের দিকে তাকাতে হয়। ছবি তুললাম পটাপট।
সারাদিন না খেয়ে আছি অথচ ক্ষুধা পাচ্ছে না, যা দেখছি তাতে ক্ষুধা থাকে না। সাড়ে ৫টা নাগাদ আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল। বিকালের সোনালি সূর্য মেঘের ওপরে দিয়ে লুকোচুরি করে পাহাড়ে এসে পড়েছে। এ যে কী অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না। গাড়ি চলছিল। এবার নিচের দিকে, তাই ড্রাইভারকে বেশি বেগ পেতে হলো না। পাহাড়ি কলাগাছ আর কাশফুল ছেয়ে আছে পাহাড়গুলোয়।
পাহাড়ে সন্ধ্যাটা ঝুপ করেই নেমে পড়ে। আমাদের পৌঁছনোর আধঘণ্টা আগেই সন্ধ্যা নেমে এলো। পাহাড়ের পথে রাতের অভিজ্ঞতাও মন্দ নয়। বান্দরবান শহরটি কিন্তু বলতে গেলে গর্তের মধ্যে, মানে চারপাশে পাহাড় তার মধ্যে বান্দরবান। এবার গাড়ি চলেছে কক্সবাজারের উদ্দেশে। ড্রাইভার বললো, ঘণ্টা তিনেক লাগবে। হোটেল বিচ হলিডেতে আমাদের রুম বুক করা ছিল। উঠে পড়লাম রুমে। একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতের সমুদ্র দেখতে ১১টার দিকে বিচের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। হোটেল থেকে হেঁটে বিচে যেতে সময় লাগল পাঁচ মিনিট।
ভাবলাম মন্দ নয়। এখানকার ভাবই আলাদা। দেখলাম ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় মনিটর লাগিয়ে ধুমধাম গান বাজাচ্ছে। দেখে হাসি পেল। সুগন্ধা বিচের সামনে আসতেই সমুদ্রের ডাক শুনতে পেলাম। রাতের সমুদ্র দেখে মন ভরে না। প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়ালাম ওখানে। ঢেউগুলো সাদা ঘোড়ার বেশে কূলে আছড়ে পড়ছিল। মন চচ্ছিল নামি, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করলাম। নির্মল বাতাসে মন ভরে যাচ্ছিল। কিছু সময় থেকে ফিরে এলাম হোটেলে। কিছু সমস্যা থাকায় পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হোটেল পরিবর্তন করে পাশেই হোটেল সি কিংয়ে উঠলাম। হোটেলটা বেশ মনোরম। সবকিছু রেখে গেলাম সমুদ্রের কাছে। সমুদ্রে পা ভেজালাম। বিশালাকায় ঢেউ আমার পা বেয়ে ওপরে উঠে আসছিল। গোটা শরীর শিরশির করছিল। কী স্নিগ্ধ তার পরশ। সাদা ঢেউয়ে আমি হারিয়ে গেলাম, ভিজলাম। শেষে গোসল করলাম। ঝাঁপাঝাঁপিও করলাম বেশ কিছু সময়। ওখানে খুব কম টাকায় ফটোগ্রাফার পাওয়া যায়। প্রতি ছবি ১৫ টাকা। বেশ কিছু ছবিও তুললাম। অবশেষে ফিরে এলাম প্রাণের ফরিদপুরে। এখনও চোখে ভাসে সেই দৃশ্যগুলো, যা দেখেছি তা-ই আমার বাংলাদেশ, যাকে জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন ‘রূপসী বাংলা’।
তাসনোভা বিন্তে ইকবাল