রেকর্ড লোডশেডিংয়ে ম্লান সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন!

বিশেষ প্রতিনিধি: ১১ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত টানা তিন দিন সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড গড়ে বিদ্যুৎ খাত। তবে সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বরং পরের তিন দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। আর তাপমাত্রা বাড়ায় চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ কমায় ঘাটতি বেড়েছে। এতে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ১৫ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ লোডশেডিংয়ের রেকর্ড হয়েছে।

সূত্র জানায়, কয়লা সংকটে রামপাল ও বরিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। পাশাপাশি পিডিবির কয়লাভিত্তিক নিজস্ব দুটি কেন্দ্র কয়লা সংকটে আংশিক উৎপাদন করছে। গ্যাস ও তেল সংকটে সম্পূর্ণ বা আংশিক বন্ধ রয়েছে ৪৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। পানির লেভেল কম থাকায় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন করতে পারছে না। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ বা কারিগরি ত্রুটির কারণে প্রায় ৩০টি কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। সব মিলিয়ে সক্ষমতার প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। তার ওপর হঠাৎ ১৪ এপ্রিল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ভেঙে পড়েছে। আর তেল-গ্যাস না থাকায় অন্য কেন্দ্রে উৎপাদন বাড়িয়ে ঘাটতি পূরণ করা যাচ্ছে না। এতে অনেকটা বাধ্য হয়েই লোডশেডিং বাড়াতে হয়েছে। তবে রামপাল কেন্দ্রের কয়লা পথেই আছে। সেটি এলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। যদিও তাপমাত্রা না কমলে দ্রুত লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১১ এপ্রিল দেশে প্রথম সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়। ওইদিন রাত ৯টায় ১৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এর আগে ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল। তবে সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড ভাঙলেও ১১ এপ্রিল সীমিত আকারে লোডশেডিং হয়। ওইদিন বেলা ১১টায় সর্বোচ্চ ৩৬৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।

পরের দিন তথা ১২ এপ্রিল রাত ৯টায় আবারও বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। ওই সময় ১৪ হাজার ৯৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ১২ এপ্রিল বিদ্যুতের চাহিদা ছিল বেশি। ফলে সর্বোচ্চ উৎপাদনের মাত্র ৩ ঘণ্টা পর অর্থাৎ রাত ১২টায় সর্বোচ্চ ৭৪৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেয়া হয়। একইভাবে ১৩ এপ্রিল রাত ৯টায় দেশে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন রেকর্ড হয়। তবে ওই সময়ও ৩০৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। যদিও ওইদিন সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল বিকাল ৪টায় ৭৭৬ মেগাওয়াট। তাপমাত্রা বাড়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লোডশেডিংও বৃদ্ধি পায় ওইদিন।

পরের দিন (১৪ এপ্রিল) পহেলা বৈশাখের ছুটিতে ভয়াবহ আকার ধারণ করে লোডশেডিং। সেদিন রাত ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়। সারাদিন তা ওঠানামা করলেও রাত ১১টার পর আবারও লোডশেডিং হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। এর মধ্যে রাত ৩টায় সর্বোচ্চ এক হাজার ২৮০ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। আর ১৪ এপ্রিল রাত ৯টায় সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৮৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। কয়লা সংকটে সেদিন রামপালের একটি ইউনিটে আংশিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।

১৫ এপ্রিল কয়লার মজুত শেষ হয়ে যাওয়ায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ওইদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও হ্রাস পায়। ১৫ এপ্রিল রাত ৯টায় সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৯৬৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যদিও ওইদিন ঢাকায় রেকর্ড ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। ফলে ঢাকাসহ সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল অনেক বেশি। ফলে ওইদিন বিকাল ৫টায় দুই  হাজার ৫০৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়, যা বাংলাদেশে রেকর্ড। এর আগে গত বছর ৮ অক্টোবর রেকর্ড ২ হাজার ১০৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫ এপ্রিল জ্বালানি তেল (ফার্নেস অয়েল) সংকটে ২৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পূর্ণ বা আংশিক বন্ধ ছিল। আর গ্যাস সংকটে পূর্ণ বা আংশিক বন্ধ ছিল ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া কয়লা সংকটে পুরোপুরি বন্ধ ছিল রামপাল ও বরিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। পিডিবির বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট আংশিক উৎপাদন করে। এছাড়া পানির লেভেল কম থাকায় ২৩০ মেগাওয়াটের মধ্যে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।

পরের দিন (১৬ এপ্রিল) বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা বাড়ে। ফলে লোডশেডিং সামান্য কমে। ওইদিন রাত ৯টায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৫৯৯ মেগাওয়াট। সে সময় এক হাজার ২৯১ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। এর মাত্র তিন ঘণ্টা পর লোডশেডিং আরও বেড়ে সর্বোচ্চ এক হাজার ৮৬৬ মেগাওয়াটে ঠেকে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৬ এপ্রিলও ঢাকায় রেকর্ড (৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা ছিল।

সূত্র জানায়, বর্তমানে পিডিবির অধীনে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (আমদানিসহ) ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১৩ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদন হলেও সক্ষমতার মাত্র ৬৫ শতাংশ ব্যবহার হয়। আর দিনে তা সর্বোচ্চ ৫৬ শতাংশ ব্যবহার হয়েছিল। জ্বালানি সংকট ছাড়াও কারিগরি ত্রুটি বা রক্ষণাবেক্ষণের কারণে প্রায় ৩০টি কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। ফলে বর্তমানে প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতা ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হবে না।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কত, তা আগে নির্ধারণ করা দরকার। এর ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা করা উচিত। পাশাপাশি প্রকৃত চাহিদা বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর মাধ্যমে পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। তাহলে প্রকৃত ঘাটতি তথা লোডশেডিংয়ের চিত্র পাওয়া যাবে। বর্তমানে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা খণ্ড চিত্র মাত্র।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০