ইসমাইল আলী: চলতি বছর শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে গ্যাসের দাম। এতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি অনেক কমে গেছে। ফলে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। এ কারণে চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে রেকর্ড ভর্তুকি লাগবে। এজন্য প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে এ প্রস্তাব পাঠানো হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
সূত্র জানায়, গত অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল মাত্র ৯ হাজার কোটি টাকা। তবে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন বাড়ানোর কারণে তাতে ঘাটতি দেখা দেয়। এতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি প্রয়োজন পড়ে প্রায় ১১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। এজন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে গত মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে পিডিবি।
এদিকে চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি চিত্র আরও করুণ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, চলতি অর্থবছরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এ অর্থ দিয়ে পুরো অর্থবছরের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে না। বরং চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ১৬ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা ভর্তুকি দরকার হবে।
‘বর্তমানে গ্যাস স্বল্পতার কারণে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অধিক পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ায় সরকারের রাজস্ব বাজেটের আওতায় বিউবোকে অতিরিক্ত সহায়তা প্রদান’ শীর্ষক চিঠিতে বলা হয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে পিডিবি দীর্ঘ সময় ধরে উৎপাদন ব্যয় অপেক্ষা কম মূল্যে বাল্ক (পাইকারি) বিদ্যুৎ বিক্রি করে যাচ্ছে। এতে প্রতি বছর পিডিবির আর্থিক ঘাটতি থাকছে। এর মধ্যে শুধু আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঘাটতি সরকার রাজস্ব বাজেটের আওতায় পিডিবিকে সরবরাহ করছে। তবে গ্যাস স্বল্পতার কারণে তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন বাড়ায় অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
এ-সংক্রান্ত ব্যাখ্যা চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑগ্যাস স্বল্পতার কারণে ডিজেলভিত্তিক এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় প্রতিদিন প্রায় ৪০ কোটি টাকার ডিজেল প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে মাসিক খরচ হচ্ছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। পাঁচ হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এর অধিকাংশই আমদানি করা তেল দ্বারা পরিচালিত। আন্তর্জাতিক বাজারে এ তেলের দাম প্রতি মেট্রিক টন বেড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ ডলার হয়েছে।
এদিকে বিইআরসি বিদ্যুতের পাইকারি বিক্রয় মূল্য গড়ে পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা কমে গেছে। আর পায়রায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলেও সঞ্চালন লাইন না হওয়ায় ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কিন্তু পিডিবিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল কেনার জন্য বিপিসিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পিডিবি কর্তৃক অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়। এসব কারণে চলতি অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকির প্রয়োজন হবে প্রায় ১৬ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা।
এক্ষেত্রে মাসভিত্তিক সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ, বিক্রি ও রাজস্ব ঘাটতির হিসাবও সংযোজন করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, জুলাই মাসে ঘাটতি ছিল এক হাজার ৬৫ কোটি টাকা ও আগস্টে এক হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এছাড়া সেপ্টেম্বরের সম্ভাব্য ঘাটতি দাঁড়াবে এক হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, অক্টোবরে এক হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, নভেম্বরে এক হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, ডিসেম্বরে ৯৩৭ কোটি টাকা, জানুয়ারিতে এক হাজার ১২৫ কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ১৮৩ কোটি টাকা, মার্চে এক হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা, এপ্রিলে এক হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা, মে মাসে এক হাজার ৫৫১ কোটি টাকা ও জুনে এক হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. বেলায়েত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, চলতি অর্থবছরের জন্য বিদ্যুৎ খাতে যে অর্থ ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা অপ্রতুল। ৯ হাজার কোটি টাকায় অর্থবছরের সাত মাস চলতে পারে। ফলে ঘাটতির শঙ্কায় আগে থেকেই এ খাতে বাড়তি বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত অর্থবছরেও বরাদ্দের চেয়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভর্তুকি প্রয়োজন পড়েছে। এজন্য গত মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় পিডিবি। এতে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাস ও ফেব্রুয়ারির জন্য আংশিক ভর্তুকি ছাড় করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। এর পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৩৫২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। তবে ফেব্রুয়ারির বাকি সময়ের জন্য আরও ১৪৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দরকার। আর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে আরও চার হাজার চার কোটি ৪৩ লাখ টাকা ভর্তুকি দরকার। সব মিলিয়ে চার হাজার ১৫১ কোটি ছয় লাখ টাকা চাওয়া হয়।
এদিকে জুনের হিসাব চূড়ান্ত না হওয়ায় ভর্তুকির অর্থ চাওয়া হয়নি। তবে জুনেও প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এতে গত অর্থবছর ঘাটতি তথা ভর্তুকি প্রয়োজন পড়বে ১১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা।