Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 10:00 pm

রেকর্ড ৪৬ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পিডিবি

বিশেষ প্রতিনিধি: দেড় বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৭৩ শতাংশ। ডলারের বিনিময়হার বৃদ্ধি, নতুন উৎপাদনে আসা বড় আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লা ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, দেশে গ্যাসের মূল্য বাড়ানো ইত্যাদি কারণে এ ব্যয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ফলে দুই দফা বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য বৃদ্ধি করেও সামাল দেয়া যাচ্ছে না উৎপাদন ব্যয়ের ঘাটতি। এতে চলতি অর্থবছর রেকর্ড ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ২৭৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লা ও জ্বালানি তেলের দাম কমে আসায় আগামী অর্থবছর লোকসান কিছুটা কমবে বলে মনে করছে পিডিবি। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৮৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

যদিও আইএমএফের শর্ত মেনে ডলারের বিনিময়হার উš§ুক্ত করে দিলে আগামী অর্থবছর লোকসান অনেক বেড়ে যাবে বলেই ধারণা সংশ্লিষ্টদের। তবে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো হলে লোকসান আবার কিছুটা কমবে। সূত্রমতে, দুই বছর আগেও পিডিবির লোকসান ছিল অনেক কম। ২০২০-২১ অর্থবছর সংস্থাটি লোকসান গুনেছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। তবে ২০২১-২২ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান এক লাফে প্রায় আড়াইগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার আট কোটি ৩২ লাখ টাকা।

পিডিবির প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, চলতি অর্থবছর সংস্থাটি মোট বিদ্যুৎ বিক্রির (সম্ভাব্য) পরিমাণ দাঁড়াবে আট হাজার ৫৪৩ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি ব্যয় পড়বে ৫৫ হাজার ৮৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আর জ্বালানিবহির্ভূত (ক্যাপাসিটি চার্জ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ) ব্যয় হবে ৩৭ হাজার ২২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় পড়বে ৯৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এতে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১০ টাকা ৯০ পয়সা।

এদিকে বর্তমানে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার ছয় টাকা ৭০ পয়সা। তবে অর্থবছরের শুরুতে এ মূল্যহার ছিল পাঁচ টাকা আট পয়সা। দুই দফায় প্রায় ৩১  শতাংশ বৃদ্ধির পর বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৯৪ পয়সা। ফলে চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির সম্ভাব্য আয় দাঁড়াবে ৫০ হাজার ৬৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। এছাড়া বাদ যাবে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিলের এক হাজার ২৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ছয় শতাংশ অগ্রিম আয়কর দুই হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। এতে বিদ্যুতের গড় সরবরাহ মূল্য বেড়ে দাঁড়াবে ১১ টাকা ৬৪ পয়সা। সব ব্যয় বাদ দিয়ে চলতি অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান পড়তে পারে ৪৬ হাজার ২৭৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

যদিও গত অর্থবছর পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় ছিল আট টাকা ৫৪ পয়সা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর ছিল ছয় টাকা ৩০ পয়সা। ওই দুই অর্থবছর বিদ্যুতের বাল্ক বিক্রয়মূল্য ছিল যথাক্রমে পাঁচ টাকা আট পয়সা ও পাঁচ টাকা ১২ পয়সা। অর্থাৎ গত অর্থবছর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লোকসান অনেক বেড়েছে। চলতি অর্থবছর উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়ায় লোকসানও বৃদ্ধি পাবে।

তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির বিদ্যুৎ বিক্রির পরিমাণ ছিল আট হাজার ৩৮২ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭১ হাজার ৫৮৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আর সে বিদ্যুৎ বিক্রি করে আয় হয় ৪০ হাজার ৫৭৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৩১ হাজার আট কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর বিদ্যুৎ বিক্রি হয় সাত হাজার ৮৫২ কোটি ৫৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৪৯ হাজার ২৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আর ওই অর্থবছর পিডিরিব আয় হয় ৩৭ হাজার ৭২৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এতে সংস্থাটির লোকসান দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৯ কোটি ১২ লাখ টাকা।

পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, আগে পিডিবি বছরে যে পরিমাণ লোকসান গুনত, এখন এক মাসেই তার কাছাকাছি পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে দুই দফা বাল্ক বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে ব্যয় আরও বেশি হারে বেড়েছে। আবার ৮৫ টাকার ডলার এখন ১০৭ টাকা (ব্যাংক রেট)। এসব কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সুফল অতটা পাওয়া যাচ্ছে না।

তারা আরও বলেন, নতুন বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে বা আসছে। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এ কারণেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে। আবার আইএমএফের শর্ত মেনে ডলারের বিনিময় হার উš§ুক্ত করে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এতে ডলারের বিনিময় হার এক টাকা বাড়লে পিডিবির লোকসান বাড়বে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। তাই আগামী অর্থবছরের প্রকৃত অবস্থা একই ধারণা করা যাচ্ছে না। তবে সবকিছু অপরিবর্তিত থাকলে আগামী অর্থবছর লোকসান কমত।