রোহান রাজিব:সরকার ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি এক অর্থবছরের হিসাবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে সিংহভাগ ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঋণের পুরো অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাপিয়ে দেয়া হয়েছে। টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কড়াকড়ি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক ধারায় নেমেছে। বৈদেশিক ঋণ ছাড়েও গতি নেই। সরকারের রাজস্ব আদায়েও চলছে ধীরগতি। এমন বাস্তবতায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঢালাওভাবে ঋণ নিচ্ছে সরকার। তবে এবার বাংকঋণের সিংহভাগের জোগান দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। কারণ তারল্যে টান পড়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকটের কারণে সরকার ঋণ পায়নি। তাই বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়েছে। চাহিদা মেটাতে চলতি অর্থবছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়।
এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে গত মে মাসের মতো মূল্যস্ফীতির এত চাপে পড়েনি সাধারণ মানুষ। গত মাসে সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা গত ১৩৪ মাস বা ১১ বছর দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত সোমবার মে মাসের মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এর আগে ২০১২ সালের মার্চে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর আর কখনও মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে যায়নি। ওই বছরের পরের মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমে আসে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য।
প্রতি বছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট পেশ করে আসছে সরকার। এই ঘাটতি মেটানো হয় দুটি উৎস থেকেÑঅভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত। বৈদেশিক খাত থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পাওয়া না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয় সরকারকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে রয়েছেÑব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র খাত। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। তারল্য সংকট থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে চাইলেও প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছে না সরকার। আবার ঋণ পেলেও সুদের হার বেশি দাবি করা হচ্ছে। কারণ কভিড-১৯ মহামারির পর চাহিদা বৃদ্ধি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক কয়েক দফা নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহের খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নানা কড়াকড়িতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে মন্দা চলছে। বৈদেশিক ঋণ ছাড়েও গতি নেই। রাজস্ব আদায়ও লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে নতুন টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়। এতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে তা মূল্যস্ফীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ যত বাড়বে মূল্যস্ফীতি তত বৃদ্ধি পাবে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঋণের অর্থ ছাপিয়ে দিচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশ ব্যাংককে ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ পরিমাণ ঋণ নেয়া হয়নি। খুবই সামান্য নেয়া হতো। সেটা ক্যাশ না থাকার কারণে এক দিনের জন্য হতো। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া নীতিধারা শুরু হয়েছে। এ নীতিধারা চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। বরং মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ বেড়ে এক লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত ৩১ মে শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০১ কোটি টাকায়। গত ৩০ জুনে যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৯২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে মাত্র ২০ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা। যদিও গত মার্চ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার কোনো ঋণই নিতে পারেনি। উল্টো আগের নেয়া ঋণ পরিশোধ করে আসছিল। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার রেকর্ড ৭১ হাজার ৬১০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬০৩ কোটি টাকায়।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছিল মাত্র ৩২ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছিল ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিয়েছিল ৩০ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। এছাড়া গত অর্থবছরের পুরো সময়ে সরকারের নিট ঋণ নেয়ার পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এটি তার আগের তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। তবে এবার সেই রেকর্ডও ভাঙল সরকার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নেবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।