Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 8:36 pm

রেন্টাল-কুইক রেন্টালে লোকসান ২৩ হাজার কোটি টাকা

বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে ২০০৯ সালে বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। অদক্ষ এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। যদিও করোনার কারণে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাওয়ায় কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগই বসে থাকছে। ফলে বোঝা হয়ে ওঠা রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরকারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে আজ ছাপা হচ্ছে ধারাবাহিকের শেষ পর্ব

ইসমাইল আলী: এক দশক আগে বেসরকারি খাতে বেশকিছু রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয় সরকার। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। বিশেষ করে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর ইউনিটপ্রতি ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি।

অথচ বিদ্যুতের বিক্রি মূল্য অনেক কম। ফলে উচ্চ দরে কিনে কম দামে বিক্রি করায় ৯ বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) লোকসান গুনেছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। যদিও বেসরকারি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতি বছর মুনাফা করছে।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ৯ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় সাত হাজার ৩৬১ কোটি ৮৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ কেনায় পিডিবির ব্যয় হয় ৬৫ হাজার ৮১৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর উৎপাদিত এ বিদ্যুৎ পাইকারি (বাল্ক) পর্যায়ে বিক্রি হয় ৪২ হাজার ৮২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায়। এতে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ২২ হাজার ৯৮৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

৯ বছরের মধ্যে রেন্টাল-কুইক রেন্টালে পিডিবির সবচেয়ে লোকসান হয় ২০১২-১৩ অর্থবছরে। ওই বছর এ খাত থেকে পিডিবির বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ৯৪০ কোটি ৯০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৭৯ ইউনিট। এতে পিডিবির ব্যয় হয় প্রায় ১০ হাজার ৩৪০ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। আর গড় ব্যয় ছিল ১০ টাকা ৯৯ পয়সা। তবে এ বিদ্যুতের গড় বাল্ক বিক্রি মূল্য ছিল পাঁচ টাকা ৯৬ পয়সা। এতে সে অর্থবছর পিডিবির লোকসান হয় চার হাজার ৭৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

রেন্টাল-কুইক রেন্টালে পিডিবির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লোকসান ছিল তার আগের অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবছরে। ওই বছর এ খাত থেকে পিডিবির বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ৮৬৮ কোটি ৯ লাখ ৭১ হাজার ৭৪৪ ইউনিট। এতে পিডিবির ব্যয় হয় প্রায় আট হাজার ৮৩৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর গড় ব্যয় ছিল ১০ টাকা ১৮ পয়সা। তবে এ বিদ্যুতের গড় বাল্ক বিক্রি মূল্য ছিল পাঁচ টাকা ৩৫ পয়সা। এতে সে অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় চার হাজার ১৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

রেন্টাল-কুইক রেন্টালে পিডিবির তৃতীয় সর্বোচ্চ লোকসান ছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। পিডিবি সে বছর এ খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনে ৯৬৩ কোটি ৩০ লাখ ৭৮ হাজার ইউনিট। এতে পিডিবির ব্যয় হয় প্রায় ৯ হাজার ৭৫০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর গড় ব্যয় পড়ে ১০ টাকা ১২ পয়সা। সে বছর বিদ্যুতের গড় বাল্ক বিক্রি মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ছয় টাকা ২৫ পয়সা। এতে পিডিবির লোকসান কিছুটা দাঁড়ায় তিন হাজার ৭২৮ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরপর বিভিন্ন সময়ে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি নবায়নের সময় ক্যাপসিটি চার্জ কিছুটা কমানো হয়। এছাড়া বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কমায় এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কিছুটা হ্রাস পায়। পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়। আর বেসরকারি খাতে বড় বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর পর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা কমিয়ে দেয় পিডিবি। এ কারণেও পরের বছরগুলোয় এ খাতে সংস্থাটির লোকসান কমে আসে।

তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর রেন্টাল-কুইক রেন্টালে পিডিবির লোকসান কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ৫৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকায়। সে বছর এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ৯৮৫ কোটি ৮৩ লাখ ৯২ হাজার ৮০৭ ইউনিট। এটি রেন্টাল খাতে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ। এ বিদ্যুৎ কেনায় গড়ে ব্যয় হয় আট টাকা ৯০ পয়সা। আর সে বিদ্যুতের বাল্ক বিক্রি মূল্য ছিল ছয় টাকা ২৭ পয়সা।

পরের অর্থবছর পিডিবির লোকসান আরও কমে দাঁড়ায় এক হাজার ২৬৯ কোটি পাঁচ লাখ টাকায়। সে বছর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ৯৩৩ কোটি ১২ লাখ ৬৩ হাজার ৭৯৩ ইউনিট। এতে গড় খরচ পড়ে ছয় টাকা ৯১ পয়সা। আর বাল্ক বিক্রয় মূল্য ছিল পাঁচ টাকা ৫৫ পয়সা।

পরের তিন অর্থবছর (২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯) রেন্টাল-কুইক রেন্টালে পিডিবির লোকসান ছিল যথাক্রমে এক হাজার ৩৫৪ কোটি ২১ লাখ টাকা, এক হাজার ৬২৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ও এক হাজার ৪০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ওই সময় রেন্টাল-কুইক রেন্টাল খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমেছে।

২০১৬-১৭ অর্থবছর ৮১৫ কোটি ৭৮ লাখ ৮২ হাজার ৩২০ ইউনিট, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৭১৬ কোটি চার লাখ ৮৮ হাজার ৭২ ইউনিট ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৫৯৬ কোটি ৫৮ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬০ ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হয় রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে। এসব বিদ্যুৎ কেনায় গড় ব্যয় ছিল যথাক্রমে সাত টাকা ৩৬ পয়সা, আট টাকা ৭৭ পয়সা ও আট টাকা ৪১ পয়সা। আর এ বিদ্যুতের বাল্ক বিক্রি মূল্য ছিল যথাক্রমে পাঁচ টাকা ৭০ পয়সা, ছয় টাকা ৫০ পয়সা ও ছয় টাকা ছয় পয়সা।

এদিকে ২০১০-১১ অর্থবছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ কেনায় গড় ব্যয় ছিল আট টাকা পাঁচ পয়সা। সে বছর এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ৫৪২ কোটি ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৭১৮ ইউনিট, যা ছিল সর্বনি¤œ। সে বছর বিদ্যুতের বাল্ক বিক্রি মূল্য ছিল চার টাকা ২০ পয়সা। এতে পিডিবির লোকসান হয় দুই হাজার ৮৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৯ বছরে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ২২ হাজার ৯৮৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।