বেসরকারি বিদ্যুৎ খাত

রেন্টাল বন্ধের নামে ফাঁকি চলবে আইপিপি কেন্দ্র

ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় ২০০৯ সালে ভাড়াভিত্তিক বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয় সরকার। পরে সেগুলোর মেয়াদ কয়েক দফা বৃদ্ধি করা হয়, যা ২০২৪ সাল নাগাদ হবে। এগুলোর চুক্তি আর নবায়ন করা হবে না বলে সম্প্রতি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে জানায় বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও বেসরকারি খাতে স্থাপিত বড় আকারের রেন্টাল তথা আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলো ঠিকই চালু থাকছে। নতুন আরও আইপিপির লাইসেন্সও দেয়া হচ্ছে।

তথ্যমতে, বর্তমানে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রর রয়েছে ২০টি। আর আইপিপির সংখ্যা ৬৯টি। এগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রভেদে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি রয়েছে ১৫-২২ বছরের। আরও বেশকিছু আইপিপি নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়া লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে আরও কয়েকটির। এগুলোর সংখ্যা ৪৫টি। অথচ দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের এতটা চাহিদা নেই। ফলে রেন্টালের মতো বসিয়ে রেখে আইপিপিগুলোতেও মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে সরকারকে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে ৩-৫ বছর মেয়াদি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ১৬টি। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ১৩২ মেগাওয়াট। আর ১৫ বছর মেয়াদি চারটি রেন্টাল কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১৬৯ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে ২০টি রেন্টাল কেন্দ্রের ক্ষমতা এক হাজার ৩০১ মেগাওয়াট।

যদিও বিদ্যমান, নির্মাণাধীন ও লাইসেন্স ইস্যুর প্রক্রিয়াধীন আইপিপিগুলোর সংখ্যা ১১৪টি। এগুলোর সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ হাজার ৮৭৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে উৎপাদনে রয়েছে আট হাজার ৮৩ মেগাওয়াটের আইপিপি। আরও আসছে আট হাজার ৭৯০ মেগাওয়াটের আইপিপি। ফলে রেন্টাল বন্ধ হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা না কমে উল্টো বেড়ে যাবে। এতে একদিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্টের বোঝা বাড়বে, অন্যদিকে চাহিদা না থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকার হার অনেক বেড়ে যাবে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে ৫৬টি বড় আইপিপি। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা সাত হাজার ৭৩৩ মেগাওয়াট। আর চারটি ছোট আকারের আইপিপি তথা এসআইপিপির উৎপাদন ক্ষমতা ৯৯ মেগাওয়াট, যেগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনে পিডিবি। এছাড়া ২৫১ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৯টি এসআইপিপি থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ কিনছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। সব মিলিয়ে আইপিপিগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা আট হাজার ৬৩ মেগাওয়াট।

এর বাইরে উৎপাদনে আসছে আরও ২২টি আইপিপি। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ হাজার ৭২৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১৩টি আইপিপি গ্যাস অথবা কয়লাভিত্তিক। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ হাজার ২৩২ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্রের মধ্যে একটি কেন্দ্র পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে। আরও দুটি কেন্দ্র চলতি মাসেই উৎপাদন শুরু করবে। এছাড়া আগামী বছর জুনের মধ্যে আরও পাঁচটি কেন্দ্রের উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসবে।

পিডিবির তথ্যমতে, নির্মাণাধীন আইপিপিগুলোর মধ্যে কয়েকটির উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের এসএস পাওয়ারের উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রটি বিদ্যমান সব রেন্টালের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে।

এর বাইরে সামিট মেঘনাঘাট-২ কেন্দ্রের ক্ষমতা ৫৮৩ মেগাওয়াট, ইউনিট মেঘনাঘাট কেন্দ্রের ক্ষমতা ৫৮৪ মেগাওয়াট, ভারতের রিলায়েন্সের ক্ষমতা ৭১৮ মেগাওয়াট, ওরিয়নের ঢাকা পাওয়ার-১-এর ক্ষমতা ৫২২ মেগাওয়াট ও ঢাকা পাওয়ার-২-এর ক্ষমতা ৬৩৫ মেগাওয়াট এবং বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ারের ক্ষমতা ৩০৭ মেগাওয়াট উল্লেখযোগ্য।

এদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি তথা সৌর বিদ্যুতের নির্মাণাধীন আইপিপি রয়েছে ৯টি। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৪৯৭ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বাগেরহাটের ১০০ মেগাওয়াট ও গাইবান্ধার ২০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র দুটি সবচেয়ে বড়। বাকিগুলো উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ থেকে ৬০ মেগাওয়াট। আগামী বছরের মধ্যে এ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বেসরকারি আইপিপির উৎপাদনে আসার প্রক্রিয়া এখানেই শেষ নয়। আরও চারটি বড় আইপিপির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে বা দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার ৬১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে চীনের হাংঝু কোম্পানি কয়লাভিত্তিক আইপিপির উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ২৪০ মেগাওয়াট। এছাড়া ইউনাইটেড করপোরেশনের ৫৯০ মেগাওয়াট ও আনলিমা গ্রুপের ৪৫০ মেগাওয়াটের আইপিপি দুটি গ্যাস/এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।

একইভাবে ৫৩১ মেগাওয়াটের ১৯টি সৌরবিদ্যুৎভিত্তিক আইপিপির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এগুলো ২০২৩ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এর মধ্যে একটি কেন্দ্রের ক্ষমতা ১০০ মেগাওয়াট। আর ৫০ মেগাওয়াটের আইপিপি রয়েছে তিনটি ও ৫৫ মেগাওয়াটের দুটি। এর বাইরে ৫০ মেগাওয়াটের আরও চারটি সৌরবিদ্যুৎচালিত আইপিপির দরপত্র মূল্যায়নাধীন রয়েছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাত নির্ভরশীলতা প্রসঙ্গে ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে দেশে অলস বসে আছে প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র। উৎপাদন না হলেও বেসরকারি খাতের এসব কেন্দ্রের জন্য মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। এরপরও নতুন নতুন কেন্দ্রের লাইসেন্স দিয়ে সরকারের বোঝা বাড়ানো হচ্ছে। তাই নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া এখনই বন্ধ করা উচিত। পাশাপাশি পুরোনোগুলোর চুক্তিও রিভিউ করা উচিত।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুতের মাস্টারপ্ল্যান রিভিউ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা কতÑসেটা পুনরায় নিরূপণ করা হবে। এজন্য জাইকা (জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা) দ্রুতই কাজ শুরু করবে। এরই মধ্যে জাইকার সঙ্গে এমওডি (মিনিটস অব ডিসকাশন) সই করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান রিভিউ করার পর যদি দেখা যায় প্রাক্কলনের চেয়ে চাহিদা কম, তাহলে পরিকল্পনাধীন কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করা হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০