ইসমাইল আলী: বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে ২০০৮ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয় সরকার। তিন ও পাঁচ বছরের জন্য বেশিরভাগ কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হলেও পরে সেগুলোর চুক্তি দফায় দফায় নবায়ন করা হয়। এমনকি ১০ বছর পেরুলেও এখনও বেশকিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা হয়েছে। আর এসব কেন্দ্রের জন্য বছরে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে দুই হাজার ৭২৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোটের (বিডব্লিউজিইডি) প্রকাশিত ‘বিপিডিবি ট্রাপড বাই এক্সপেনসিভ রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ রেন্টাল কেন্দ্রগুলো চালু রাখায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে হচ্ছে। আবার এসব কেন্দ্র চালু রাখায় বড় বড় ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির মেয়াদ (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট তথা পিপিএ) নিরাপদ অপারেশন লাইফটাইমের আড়াইগুণ বাড়ানো হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও পুরোনো এসব কেন্দ্রের জন্য বছরে দুই হাজার ৭২৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে হবে বিপিডিবিকে। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জই গুনতে হবে ৫৯৪ কোটি টাকা।
এদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত ৭ মার্চ জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৪০ ডলার উঠেছে। এতে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১৭ শতাংশ ও ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় ব্যয় ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। আর মেয়াদোত্তীর্ণ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোয় তা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর দ্বিগুণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিদ্যুতের চরম সংকট মোকাবিলায় ১৫ বছর আগে ১৪টি রেন্টাল ও ১৮টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। ২০০৮ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে তিন বছর মেয়াদি রোডম্যাপ ২০০৮-২০১১ প্রণয়নও করা হয়। পরে একটি নীতিমালায় তিন ধরনের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে ১৫ বছর মেয়াদি কয়েকটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রেরঅনুমোদন দেয়া হয়, যেগুলোর উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক কম ছিল।
অপর দুটি ক্যাটেগরির মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি কেন্দ্রগুলোর ব্যয় কিছুটা বেশি ও তিন বছর মেয়াদি কেন্দ্রগুলোর ব্যয় সবচেয়ে বেশি ছিল। তবে তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদি সেসব কেন্দ্রের মধ্যে ১৫টি এখনও চালু আছে। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের জন্য ২০১০ সালে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়, যা এগুলোকে পরিবেশ আইন থেকেও অব্যাহতি দেয়। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তির মেয়াদ শেষে বারবার তা নবায়ন করা হয়। যদিও বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি।
তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। আর গত অর্থবছর সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট। তবে চাহিদা না থাকলেও গত অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি ২১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে সরকারকে। এদিকে চলতি বছর আরও ১৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এতে সাত হাজার ৩৭৪ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা যোগ হবে। এতে চলতি বছরশেষে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৮৫১ মেগাওয়াটে পৌঁছানোর কথা। আর এ সময় সর্বোচ্চ সম্ভাব্য চাহিদা দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। আর বিপিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ২৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা।
এদিকে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোয় বিপিডিবিকে কমপক্ষে ৩২১ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে। এছাড়া ডিজেলচালিত আরও পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিপিডিবি। সেসব কেন্দ্রের জন্য অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে এক হাজার ৫২২ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েকটি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ নবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি রয়েছে গ্যাসচালিত। এমনই একটি ভোলার ৩৪ দশমিক ৫ মেগাওয়াট কেন্দ্র, যার ক্যাপাসিটি চার্জ ৩২ কোটি টাকা। ১৩ বছর পরিচালনার পরও এ কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ৯০ কোটি টাকা। একইভাবে আশুগঞ্জের ৫৩ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ১০ বছর পরিচালনার পরও চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৯১ কোটি টাকা, আর বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ৪৫২ কোটি টাকা।
একইভাবে বগুড়ায় ২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিও ১০ বছর পরিচালনার পর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ১৮ কোটি টাকা, আর বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ৫৪ কোটি টাকা। ফেঞ্চুগঞ্জের ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিও ১০ বছর পরিচালনার পর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৪৭ কোটি টাকা আর বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ১৪১ কোটি টাকা। আর কুমারগাঁও ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ১৩ বছর পরিচালনার পর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কেনায় বছরে ব্যয় হবে ৪৩ কোটি টাকা।
এদিকে ফার্নেস অয়েলচালিত খুলনার ১৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিও (কেপিসিএল-২) ১০ বছর পরিচালনার পর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ১৫৮ কোটি টাকা, আর বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ৩৫৪ কোটি টাকা। মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিও ১০ বছর পরিচালনার পর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৯২ কোটি টাকা, আর বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ৩৩২ কোটি টাকা। একইভাবে মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ১০ বছর পরিচালনার পর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৯৩ কোটি টাকা, আর বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ৩৩৪ কোটি টাকা।
একইভাবে নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি (কেপিসিএল-৩) ১০ বছর পরিচালনার পরও চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৬০ কোটি টাকা, আর বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ১৫৩ কোটি টাকা। আর সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ১০ বছর পরিচালনার পরও চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ১৩১ কোটি টাকা, আর বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ৩১৯ কোটি টাকা।
এদিকে রেন্টালের মতো ছোট আইপিপি কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদও নবায়ন করা হয়েছে। মাধবধী ২৪ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ১৫ বছর পরিচালনার পরও চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। আর চান্দিনা ১৪ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিও ১৫ বছর পরিচালনার পর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া ঘোড়াশাল ৭৮ মেগাওয়াট, আমনুরা ৫০ মেগাওয়াট, ভোলা ৯৫ মেগাওয়াট, ঝুলদা ১০০ মেগাওয়াট, কেরানীগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, কাটাখালী ৫০ মেগাওয়াট ও চান্দিনা ১১ মেগাওয়াট কেন্দ্রগুলোর চুক্তিও নবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।