মো. ফুয়াদ হাসান: করোনাভাইরাস বর্তমান বিশ্ববাসীর কাছে এক আতঙ্কের নাম। মাত্র কয়েক মাসেই এটি পৃথিবীর বাসিন্দাদের উপহার দিয়েছে এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো আজ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে দেশগুলোর জন্য। খাদ্য ও তেলের বাজারে অস্থিতিশীলতা আমাদের বাধ্য করছে অসহায়ত্ব বরণ করতে। করোনার ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। আয় কমছে বহু মানুষের। আইএলও’র তথ্যমতে, করোনার প্রভাবে পৃথিবীতে নতুন করে ৩৩০ কোটি মানুষ কর্মহীন হতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। যদিও আইএলও’র মতে, দেশে কর্মক্ষম প্রায় চার কোটি ৮২ লাখ মানুষ কর্মহীন। করোনার প্রভাবে বেকারত্বের ও নিম্ন-আয়ের মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরেও টানা চতুর্থ মাসের মতো ঊর্ধ্বমুখিতায় ছিল বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য সূচক। ওই সময় বৈশ্বিক গড় খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে দুই শতাংশেরও বেশি।
করোনার সৃষ্ট অনিশ্চয়তা বিশ্ব অর্থনীতি যখন শ্বাস নিতে পারছে না, দেশে দেশে যখন বিভিন্ন সূচকের নি¤œগতি চলমান, ঠিক এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রশান্তি রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি। এপ্রিলের শুরুতে বিশ্বব্যাংক শঙ্কা প্রকাশ করেছিল, কভিডের প্রভাবে এ বছর বাংলাদেশে রেমিট্যান্স ২২ শতাংশ কমে ১৪ বিলিয়ন ডলারে নামতে পারে। বিশ্বব্যাংক জানিছে, মহামারির কারণে বেশিরভাগ দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস নামলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৩ শতাংশ। এটা আরও বেড়ে ২০২০ সালে প্রবাসী আয়ে বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, ২০২০ সালে আট শতাংশ বেড়ে বাংলাদেশে ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসতে পারে। এদিকে বিশ্বব্যাংক ও নোম্যাডের এক প্রতিবেদন বলছে, কভিড-১৯ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) বড় গন্তব্য প্রায় সবকটি দেশেই রেমিট্যান্স প্রবাহ নেতিবাচক ছিল। এই সময়ে প্রবাসী আয় কমেছে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ারও। তবে এ পরিস্থিতি এড়াতে পেরেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মেক্সিকো। শুধু তা-ই নয়, পরের প্রান্তিকে রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধিও পেয়েছে দেশ তিনটি। রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেকর্ড ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান প্রবাসীরা। এরপর আগস্টেও ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স দুই বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসীরা ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে। রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় লাইফলাইনের মতো কাজ করে। দেশের মোট জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ফলে বর্তমানে ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বর্তমানে ১৭৪টি দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বসবাস। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী প্রবাসীদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ। মধ্যপ্রাচ্য সৌদি আরবে রয়েছে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি, তাদের সংখ্যা প্রায় এক দশমিক দুই মিলিয়ন। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, ওমান, বাহরাইন, জর্ডান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, কোরিয়া, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের বসবাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বল্পসংখ্যক জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু হয়, যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৬ সালে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে সীমিত আকারে যাওয়া প্রবাসীদের সংখ্যা ছিল ছয় হাজার ৮৭ জন। ১৯৯৩ সালে এই সংখ্যা দুই লাখ অতিক্রম করে। ২০১৭ সালে রেকর্ডসংখ্যক প্রবাসী বিদেশে পাড়ি জমায়, যার সংখ্যা ছিল ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ছয়-সাত লাখ মানুষ বিভিন্ন দেশে যায়। প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ বিদেশে যায়। এসব প্রবাসী বছরে ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেকের বেশি।
করোনার এই দুঃসময়ে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের ধাবমান গতির কিছু কারণ দেখিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছেÑ১. মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশের মুসলিম প্রবাসীরা হজের জন্য টাকা জমিয়ে রাখেন, কিন্তু মহামারির কারণে এবার হজ বন্ধ থাকায় তারা সেই টাকা দেশে পাঠিয়েছেন। ২. দেশব্যাপী হওয়া দীর্ঘমেয়াদি বন্যাকেও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বন্যায় প্রায় ১০ লাখ ঘরবাড়ি ও ৪৭ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রবাসী স্বজনরা বেশি টাকা পাঠিয়েছেন। ৩. মহামারির মধ্যে এপ্রিল-জুন সময়ে লকডাউনের কারণে অর্থ জমে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় অনানুষ্ঠানিক উপায় (হাতে হাতে বহন) থেকে আনুষ্ঠানিক বৈধ পথে (ব্যাংকের মাধ্যমে) অর্থ আসায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি হয়েছে। ৪. বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে সরকার যে দুই শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সেটিকে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক।
করোনা মহামারির মাঝেই বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্সযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে দেশের অর্থব্যবস্থা সচল হচ্ছে। তাই আমাদের উচিত তাদের ভালো রাখার ব্যবস্থা করা। কিন্তু আসলে আমরা কতটুকু নির্বিঘœ করতে পেরেছি তাদের প্রবাসজীবন। বাংলাদেশের সিংহভাগ শ্রমিক অদক্ষ বা অশিক্ষিত, ফলে তাদের নি¤œমানের কাজ দেওয়া হয়। সেসব কাজের ঝুঁকি বেশি, কিন্তু বেতন অপর্যাপ্ত। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে আমরা এখনও পিছিয়ে। প্রবাসীদের সব সমস্যার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। তাদের ভোগান্তির শুরু হয় ঘর থেকে। আমাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের বেশিরভাগ গ্রামের অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ। দালালরা প্রবাসজীবনের কষ্টের কথা গোপন করে উচ্চ বেতন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাজের জায়গা ও রাজকীয় জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের বিদেশ পাঠানোর ফাঁদে ফেলে। তারপর পাসপোর্ট, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ডাক্তারি পরীক্ষা, ভিসা, ইমিগ্রেশন, স্মার্টকার্ড, বিমানভাড়া প্রভৃতি খরচের কথা বলে সূক্ষ্মভাবে হাতিয়ে নেয় প্রয়োজনের দ্বিগুণ টাকা। সহজসরল এই মানুষগুলো প্রবাসে গিয়ে দুর্বিপাকে পড়ে। তারা মহামারির দুর্দিনে আমাদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। ভবিষ্যতে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আমাদের এখনই কাজ করতে হবে। প্রবাসীদের ভোগান্তি দূর করতে গোড়া থেকে কাজ করতে হবে এবং প্রবাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রবাহ নিশ্চত করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ দালালের ফাঁদে না পড়ে। মানবপাচারকারীদের দমন করতে হবে। দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্মূলে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের শ্রমশক্তিকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করার লক্ষ্যে কর্মসূচি নিতে হবে। তাদের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। অভিবাসন ব্যয় কমাতে হবে এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যয়ের বিষয়টা সুনির্ধারিত করতে হবে। প্রবাসে তাদের ভোগান্তি দূর করার লক্ষ্যে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। দূতাবাসগুলোকে স্বদেশি মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকারকে শ্রমবাজার বৃদ্ধির লক্ষ্য আরও নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের স্বদেশি পরিবেশ তৈরি করেতে হবে।
এদিকে গত ২২ অক্টোবর প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে ( জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে) আমদানি হয়েছে এক হাজার ১৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল এক হাজার ৩২৫ কোটি ২০ ডলারের পণ্য। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৫০ হাজার ৬৫১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে আট দশমিক ৫৬ শতাংশ কম। মহামারির আগে প্রতিমাসে পণ্য আমদানিতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করা হলেও এখন তা তিন বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ফলে বিনিয়োগ বিপর্যয়ের অশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে ডলার আসছে, তবুও শিল্পায়ন হচ্ছে না। কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়ে উঠছে না। তাই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় না করে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যবহারের পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়