নিজস্ব প্রতিবেদক: টানা তিন মাস রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল। প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। তবে জুলাইয়ে এসে প্রবাসী আয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে। গত মাসে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯০ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।
এদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ পাওয়ার পর জুনে দেশের রিজার্ভ বেড়েছিল। ওই মাসে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ২১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। তবে জুলাই শেষে তা কমে ২০ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। এক মাসে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৩০ কোটি ডলার। আর নিট রিজার্ভ কমে ১৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। জুন শেষে নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। জুলাইয়ের শুরুর দিকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) ১ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গতকাল বৃহস্পতিবার জুলাইয়ের রিজার্ভের এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে প্রতি সপ্তাহের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করলেও জুনের পর জুলাইয়ের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষ, কারফিউর ও সারাদেশে পাঁচ দিনের ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের বাড়িতে পাঠানো অর্থ সংগ্রহ করতে পারে না। তার প্রভাবে জুলাইয়ে রেমিট্যান্স কমেছে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় চলমান ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ প্রচারণার প্রভাব পড়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, ১ থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ৩৭ কোটি ডলার। ৭ থেকে ১৩ জুলাই এসেছে ৬০ কোটি ৮১ লাখ ডলার। ১৪ থেকে ২০ জুলাই এসেছে ৪৫ কোটি ডলার। ২১ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত এসেছে ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২৮ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত এসেছে ৩৪ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। সে হিসাবে জুনের চেয়ে জুলাইয়ে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কমেছে ২৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। এর আগে গত জুনে ২৫৪ কোটি ডলার আয় দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। জুনে দেশে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছিল, তা ছিল গত তিন বছরের মধ্যে একক কোনো মাসে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল।
বছরের ব্যবধানে তা কমেছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৭ কোটি ডলার। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। এরপর গত ২৩ জুলাই মঙ্গলবার পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। টানা পাঁচ দিন লেনদেন বন্ধ থাকার পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। সেদিন সুইফট সিস্টেম বিচ্ছিন্ন থাকায় অনেক ব্যাংকে কোনো প্রবাসী আয়ের অর্থ আসেনি। তবে পরদিন থেকে স্বাভাবিক বৈশ্বিক লেনদেনে ফেরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কেউ বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়ে থাকলে ব্যাংকগুলো তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিতরণ করতে বাধ্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের প্রবাসী আয় প্রেরণকারী রেমিট্যান্স হাউসগুলো যদি এ আয় ধরে রাখে, তাহলে তা দেশে আসতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণত দুই-তিন দিনের বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না।
এদিকে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ১২ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ডেকে প্রবাসী আয় বাড়াতে জোর দেয়ার তাগিদ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় সংগ্রহে প্রতি ডলার ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় সংগ্রহ করে আসছিল। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার তাদের কিছুটা বাড়তি দাম দিয়ে
হলেও বৈধ পথে আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। ফলে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম ১২০ টাকায় উঠেছে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে ডলার-সংকট চলছে। এ সংকট কাটাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় তদারকি কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের অর্থ বৈধ পথে দেশে আনার ক্ষেত্রে যে নিয়মকানুন রয়েছে, তা শিথিল করেছে। গত কয়েক মাসে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয় দেশে আসার ক্ষেত্রে। গত মাসে সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ২ হাজার ১৬১ কোটি লারের প্রবাসী আয় এসেছিল। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ৩৯১ কোটি ডলার।