নিজস্ব প্রতিবেদক: কয়েক বছর বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রবাহে উচ্চ প্রবৃদ্ধির গতি ২০২৩ সালে শ্লথ হয়ে যায়। এ সময় বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রবাহ নামমাত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশগুলোর ওপর। অনেক দেশে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ছিল। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ মাত্র তিন শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে রেমিট্যান্স আহরণে বিশ্বে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে ছিল বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাপী অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ‘দ্য গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ তথা নোমাদ-এর সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ডেটাবেজ বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী এ সংস্থাটির ‘রেমিট্যান্স সেøাড ইন ২০২৩, এক্সপেক্টেড টু গ্রো ফাস্টার ইন ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন ও ডেটাবেজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরের রেমিট্যান্স প্রবাহের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
ডেটাবেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, টানা কয়েক বছর ধরেই রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষে রয়েছে ভারত। গত বছর দেশটিতে রেমিট্যান্স এসেছে ১১৯ দশমিক ৫২৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল ১১১ দশমিক ২২২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর ভারতে প্রায় সাড়ে শতাংশ রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মেক্সিকোর রেমিট্যান্স প্রবাহ গত বছর বৃদ্ধি পেয়েছে সাত দশমিক ২২ শতাংশ। গত বছর দেশটি রেমিট্যান্স পেয়েছে ৬৬ দশমিক ২৩৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ৬১ দশমিক ৪৫৮ বিলিয়ন ডলার।
তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা চীনের রেমিট্যান্স প্রবাহ কয়েক বছর ধরেই হ্রাস পাচ্ছে। ২০২৩ সালে চীন রেমিট্যান্স পেয়েছে ৪৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ৫১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দেশটিতে গত বছর রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় তিন শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। চীন ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ৬৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন রেমিট্যান্স পায়। এরপর থেকে প্রতি বছর কমছে চীনের রেমিট্যান্স।
চতুর্থ স্থানে থাকা ফিলিপাইন্স ২০২৩ সালে রেমিট্যান্স পেয়েছে ৩৯ দশমিক ০৯৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ৩৮ দশমিক ০৪৯ বিলিয়ন ডলার। পঞ্চম স্থানে থাকা ফ্রান্স গত বছর রেমিট্যান্স পেয়েছে ৩৪ দশমিক ৭৮৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ৩৩ দশমিক ৯২৮ বিলিয়ন ডলার। এ দুই দেশে গত বছর রেমিট্যান্স বেড়েছে যথাক্রমে দুই দশমিক ৭৫ ও দুই দশমিক ৫২ শতাংশ।
রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ দেশের তালিকায় এরপর রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তান। অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত দেশটি গত বছর ২৬ দশমিক ৫৫৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, ২০২২ সালে যা ছিল ৩০ দশমিক ১৭৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর পাকিস্তানে রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় ১২ শতাংশ। দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পেয়েছিল ২০২১ সালে, যার পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৩১২ বিলিয়ন ডলার। এরপর টানা দুই বছর কমল পাকিস্তানের রেমিট্যান্স প্রবাহ।
এদিকে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২২ দশমিক ১৬৮ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২১ সালে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পেয়েছিল, যার পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ২০৬ বিলিয়ন ডলার। এরপর ২০২২ সালে তা তিন দশমিক ১৬ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৫০৫ বিলিয়ন ডলার। তবে গত বছর তা আবার তিন দশমিক ০৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের ইতিহাসে প্রথম রেমিট্যান্স প্রবাহ পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায় ২০০৬ সালে। এর তিন বছরের মাথায় ২০০৯ সালে তা ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর জন্য ছয় বছর অপেক্ষা করতে হয়। ২০১৫ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ২৯৬ বিলিয়ন ডলার। তবে পরের দুই বছর (২০১৬ ও ২০১৭ সাল) তা আবার ১৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যায়।
২০১৮ সালে আবারও রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৩৬৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তা ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ওই বছর রেমিট্যান্স এসেছিল ২১ দশমিক ৭৫২ বিলিয়ন ডলার। মূলত করোনার কারণে অনেক প্রবাসী তাদের সঞ্চিত অর্থ দেশে পাঠাতে শুরু করায় পরপর দুই বছর উচ্চ রেমিট্যান্স আসে। এতে ২০২১ সালে তা ২২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে গত বছর রেমিট্যান্স আহরণে বাংলাদেশের পরের স্থানে ছিল জার্মানি। দেশটি ২০২৩ সালে রেমিট্যান্স পেয়েছে ২০ দশমিক ৪৩১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ১৯ দশমিক ০০৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর জার্মানির রেমিট্যান্স প্রবাহ সাড়ে সাত শতাংশ বেড়েছে।
তালিকায় পরের দেশগুলোর রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে, যার মধ্যে তিনটি দেশের রেমিট্যান্স রয়েছে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এগুলোর মধ্যে গুয়েতেমালা গত বছর রেমিট্যান্স পেয়েছে ১৯ দশমিক ৯৭৮ বিলিয়ন ডলার, নাইজেরিয়া ১৯ দশমিক ৫৫০ বিলিয়ন ডলার ও মিসর ১৯ দশমিক ৫৩২ বিলিয়ন ডলার। তালিকায় ১২তম স্থানে থাকা ইউক্রেন রেমিট্যান্স ২০২৩ সালে পেয়েছে ১৫ দশমিক ১২৩ বিলিয়ন ডলার।
এর বাইরে বেলজিয়াম ১৪ দশমিক ৪৭৮ বিলিয়ন ডলার, ইন্দোনেশিয়া ১৪ দশমিক ৪৬৭ বিলিয়ন, ভিয়েতনাম ১৪ বিলিয়ন, উজবেকিস্তান ১৩ দশমিক ৯২৫ বিলিয়ন, ইতালি ১২ দশমিক ০৫৩ বিলিয়ন, মরক্কো ১১ দশমিক ৭৫০ বিলিয়ন, পর্তুগাল ১১ দশমিক ১৭৯ বিলিয়ন, নেপাল ১০ দশমিক ৮৬৭ বিলিয়ন, ডমিনিকান রিপাবলিক ১০ দশমিক ৬১৯ বিলিয়ন ও কলাম্বিয়া ১০ দশমিক ১১২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। বাকি দেশগুলোয় রেমিট্যান্স প্রবাহ ১০ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৮৫৭ দশমিক ৩০৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ৮৪২ দশমিক ৫০৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রবাহ মাত্র শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ ২০২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছিল এক শতাংশে বেশি। আর ২০২২ সালে তা বেড়েছিল শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ।