দুই বছর আগেও দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা। রেমিট্যান্স পাঠানোর এ ঊর্ধ্বগতির চিত্রের ঠিক উল্টোটাই হচ্ছে এখন প্রবাসীদের ক্ষেত্রে। গত দুই বছর রেমিট্যান্স পাঠানোর হার দিন দিন কমছে। সম্প্রতি শেয়ার বিজে প্রকাশিত ‘গতি আসছে না রেমিট্যান্স প্রবাহে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়া, ব্যাংকিং চ্যানেল-বহির্ভূতভাবে অর্থ দেশে আসা ও কিছু মুদ্রার মান কমে যাওয়াই প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৫ সালে মোট জাতীয় আয়ের ১৩ শতাংশ অবদান ছিল এ রেমিট্যান্সের।
রেমিট্যান্স-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন মতে, গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৯৫ কোটি ৮৭ লাখ মার্কিন ডলার। নভেম্বরে এসেছে ৯৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ ডিসেম্বরে মাত্র ৭৪ লাখ ডলার বেশি এসেছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো একক মাস হিসেবে নভেম্বরে ১০০ কোটি ডলারের নিচে রেমিট্যান্স দেশে আসে। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে এ ধারাবাহিকতা বজায় ছিল বলেই জানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো, বিদেশে থাকা কর্মীদের পাঠানো অর্থ। তবে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর মনোভাবই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের আয় কমেছে। ফলে তারা দেশে টাকা পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন। আবার যারা টাকা পাঠাচ্ছেন, তাদের মধ্যেও সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমশক্তি রফতানি কমে যাওয়াও রেমিট্যান্স পতনের একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উৎসাহে বাংলাদেশের প্রাইভেট ব্যাংকগুলো বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজ স্থাপন করলেও তারাও রয়েছে নানা জটিলতায়। তাই বাধ্য হয়ে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আমাদের দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন মতে, ডিসেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স আহরিত হয়েছে ২৮ কোটি ১৬ লাখ ডলার। বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৯৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এক কোটি ১২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৬১৬ কোটি ৬৮ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭৪৮ কোটি ৭১ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ বা ১৩২ কোটি তিন লাখ ডলার কম রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এ সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৭৪৮ কোটি ডলারের বেশি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে—বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম, রেমিট্যান্স প্রবাহে নিম্নগতি এবং ব্রেক্সিটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধাক্কার প্রভাব। বিশ্বে ব্যয় সংকোচনের কারণে প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়ায় তারা দেশেও অর্থ কম পাঠাচ্ছেন। পাশাপাশি অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হচ্ছে।
ব্যাংকসহ বৈধ পথে আসা বিদেশি মুদ্রার হিসাব কষে রেমিট্যান্সের তথ্য দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে আসা অর্থের হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে থাকে না। বিভিন্ন দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে লাভের আশায় হুন্ডির মাধ্যমে স্বদেশে অর্থ পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন প্রবাসীরা।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক সরকারি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদেশে কর্মরত ৮৬ লাখ বাংলাদেশির পাঠানো অর্থের ৭৮ শতাংশ আসে ব্যাংকের মাধ্যমে। হুন্ডির মাধ্যমে আসে ১২ শতাংশ। হুন্ডির এই হার এখন বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১০০ কোটি ৫৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। আগস্ট মাসে তা বেড়ে ১১৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার হয়েছিল। তারপর থেকেই কমছে রেমিট্যান্স। সেপ্টেম্বরে তা কমে ১০৫ কোটি ৫৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। অক্টোবরে তা আরও কমল। গত জুলাই থেকে আগস্টে রেমিট্যান্স বাড়লেও গত বছরের তুলনায় তা ছিল কম। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম মাসে ১৩৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। আগস্টে আসে ১১৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৩৫ কোটি ডলার, অক্টোবরে ১১০ কোটি ডলার। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ২ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছিল। তবে সেটি আগের অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছিল।
রেমিট্যান্সের এই পড়তি সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। টানা তিন মাস রেমিট্যান্সের এ ধারায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আগামী মাসগুলোতেও যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি হোঁচট খেতে পারে। বিশ্বমন্দার মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের উপরে ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে তা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর এবার ৭ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।