রহমত রহমান: রেয়াতি সুবিধায় আমদানি হয়েছে প্রায় ৪৩৬ কোটি টাকার ক্যাবল; যাতে রেয়াতি সুবিধা (শুল্ককর অব্যাহতি) নেয়া হয়েছে প্রায় ২০৩ কোটি টাকা। সুবিধা নেয়ার শর্ত ছিলÑসেই কেবল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার ছাড়া বাইরে বিক্রি করা যাবে না। অঙ্গীকারনামা দিয়ে সেই ক্যাবল কাস্টমস থেকে খালাস নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোম্পানির একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে তা বাইরে বিক্রি করা হচ্ছে। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র বা কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে পাচারের সময় কেবল ভর্তি চারটি কনটেইনার আটক করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী; যার মূল্য প্রায় ১৭ কোটি ৭ লাখ টাকা। রেয়াতি সুবিধার শর্ত ভঙ্গ করায় প্রতিষ্ঠানের রেয়াতি সুবিধা বাতিলসহ এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রতিবেদন দিয়েছে। অপরদিকে, কেবল বিক্রি ও আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এনবিআর সূত্রমতে, ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে এনবিআর সদস্যকে (শুল্কনীতি ও আইসিটি) একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়; যাতে সিপিজিসিবিএলের আমদানি করা কেবল অবৈধভাবে অপসারণ বা পাচার হওয়ায় রেয়াতি সুবিধা বাতিলসহ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিপিজিসিবিএল মাতারবাড়ির এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কেবল আমদানি করেছে। শর্ত সাপেক্ষে অঙ্গীকারনামা দিয়ে কোম্পানি রেয়াতি সুবিধায় (শুল্ককর অব্যাহতি সুবিধা) মোট ২৪০টি চালানের মাধ্যমে এসব কেবল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে সিপিসি ৪০০০-এন১৪ এবং সিপিসি ৪০০০-১৭০ সুবিধায় ৪৫টি চালানে ৩০৮ দশমিক ৮৫ মেট্রিক টন ক্যাবল আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া সিপিসি ৪০০০-এন১১ এবং সিপিসি ৪০০০-১৬৬ সুবিধায় ১৪৩টি চালানে দুই হাজার ৮০১ দশমিক ৫৯ মেট্রিক টন, সিপিসি ৪০০০-এন২৬ সুবিধায় একটি চালানে ২১ দশমিক ৮৮ মেট্রিক টন ক্যাবল আমদানি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ছাড়াও অন্যান্য কাস্টম হাউস, কাস্টমস স্টেশন দিয়ে রেয়াতি সুবিধায় কোম্পানি এসব ক্যাবল আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪০ চালানে আমদানি করা কেবলের মূল্য প্রায় ৪৩৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা; যাতে প্রায় ২০৩ কোটি টাকার শুল্ককর অব্যাহতি সুবিধা (রেয়াতি সুবিধা) নিয়েছে কোম্পানি। তবে শর্ত সাপেক্ষে অঙ্গীকারনামা নিয়ে এসব কেবল খালাস দেয়া হয়েছে।
আর বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রেয়াতি সুবিধা নেয়া এ প্রতিষ্ঠানটি চারটি ৪০ ফুট কনটেইনারের মাধ্যমে কেবল অবৈধভাবে পাচারকালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আটক করেছে। অঙ্গীকারনামার শর্ত ভঙ্গ করে অবৈধভাবে কোনো চালানে কী পরিমাণ ও কী ধরনের কেবল প্রতিষ্ঠান হতে অপসারণ করেছেÑতা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জানতে চাওয়া যেতে পারে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে অঙ্গীকারনামার শর্ত ভঙ্গের কারণে সংশ্লিষ্ট এসআরও এর আলোকে রেয়াতি সুবিধা বাতিলসহ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অপরদিকে, ৩১ আগস্ট মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অবৈধভাবে পাচারের সময় ১৭ কোটি ৭ লাখ তামার কেবল জব্দ করেছে নৌবাহিনী। এ ঘটনায় জড়িত সাতজনকে আটক করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাচারকালে এসব তামার ক্যাবল আটক করা হয়। নৌবাহিনী জানায়, গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে পাচারকালে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সৈয়দ সাকিব আহমেদের নেতৃত্বে একটি টিম বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪নং জেটিঘাট থেকে বার্জে উত্তোলনকালে ৪০ ফুটের ৪টি কনটেইনারসহ সাতজনকে আটক করে। ক্যাবলগুলো চট্টগ্রামের কোম্পানি ইকবাল মেরিন সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের করে জেটি ঘাটে নিয়ে যায় বলে জানায় নৌবাহিনী।
আটককৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এ ঘটনায় প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, প্রধান প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম এবং প্রকল্পের সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলফাজ হোসেন জড়িত। সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কোনো কোম্পানি তাদের মালিকানাধীন কোনো মালামাল বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় কোল পাওয়ার প্রথমে ইনভেস্টিগেশন করে দেখে, পণ্যগুলো কোল পাওয়ারের কি না। যদি কোল পাওয়ারের না হয়, কেবল তখনই কোল পাওয়ার এক্সিট পারমিশন দেয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রায় ১৭ কোটি ৭ লাখ টাকার ক্যাবলগুলো প্রকল্পের বাইরে বের হয়ে গেলেও কোল পাওয়ার বলছে তারা কিছু জানে না। অথচ ক্যাবলগুলে কোল পাওয়ারের সিকিউরিটি হাউসের পাশ থেকে লোড করে নিয়ে আসা হয়েছে।
অপরদিকে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৭ কোটি টাকার তামার কেবল গোপনে বিক্রি ও আত্মসাতের অভিযোগে সিপিজিসিবিএলের সাবেক এমডি আবুল কালামসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বুধবার দুদকের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক আহসানুল কবীর পলাশ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় আসামিরা হলেনÑসিপিজিসিবিএলের সাবেক এমডি মো. আবুল কালাম, সহকারী ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মো. আলফাজ উদ্দিন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইকবাল মেরিনের মালিক মো. ইকবাল হোসেন, কর্মচারী নিজাম উদ্দিন ও মো. সেলিম।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মাতারবাড়ি কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ১৭ কোটি টাকার ক্যাবল বাইরে বিক্রি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। গত আগস্ট মাসে আসামিরা তিনটি কনটেইনারের ৫৬ দশমিক ৯০ টন তামার ক্যাবল সরকারি অনুমতি না নিয়ে গোপনে বিক্রি করে দেন; যার বর্তমান বাজার আনুমানিকমূল্য ১৭ কোটি ৭ লাখ টাকা। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ এবং ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিপিজিসিবিএলের এমডি (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. নাজমুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি কখনও এ প্রজেক্টে ছিলাম না। আবুল কালাম যাওয়ার পর অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হয়েছে জানি। আপনি অফিসে এলে সংশ্লিষ্ট যিনি দেখেন তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। ক্যাবল পাচার বিষয়ে কোনো কমিটি করা হয়েছে কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইন্টারনাল কমিটি করা হয়েছে।’