রহমত রহমান: ১০০-১২০ বর্গফুটের অফিস। দেয়ালে সাঁটানো পোস্টারে প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড। নেই প্লান্ট, মেশিনারিজ বা কনস্ট্রাকশন। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান নিজেকে উৎপাদনকারী দাবি করে। অথচ আমদানি করা কাঁচামাল (স্ট্রিম কোল, লাইম স্টোন, ব্রোকেন বা ক্রাশ স্টোন) কোনো প্রকার প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই সরাসরি বিক্রি করে দেয়। আবার আমদানি করা কাঁচামালের উৎপাদনকারী হিসেবে নিয়েছে সিপিসি (কাস্টমস প্রসিকিউর কোড) বা রেয়াতি সুবিধা। অথচ রেয়াতি সুবিধা পেতে হলে শর্ত হলো প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদনকারী হতে হবে। বিধিবহির্ভূতভাবে রেয়াত নেয়া প্রতিষ্ঠান হলো প্লানেট কনস্ট্রাকশন। কাস্টমস গোয়েন্দার অনুসন্ধানে অবৈধভাবে রেয়াত নেয়া এ নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকি উঠে এসেছে। সিপিসি সুবিধার আড়ালে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। যাচাই না করে নামসর্বস্ব এমন প্রতিষ্ঠানকে সিপিসি সুবিধা দেয়ায় হতবাক কাস্টমস কর্মকর্তারা। তবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তাদের প্লান্ট, মেশিনারিজ সব রয়েছে। সব বিধি মেনেই রেয়াত নেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিপিসি সুবিধা একেবারে সস্তা হয়ে গেছে। সিপিসি সুবিধা দেয়ার আগে প্রতিষ্ঠান যাচাই করা উচিত। ভ্যাট অফিস সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠান যাচাই করলে অপব্যবহার বন্ধ হবে। নামসর্বস্ব ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান সিপিসি সুবিধার অপব্যবহার করছে। যার ফলে যোগ্য প্রতিষ্ঠানও সিপিসি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কাস্টমস গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের মেসার্স প্লানেট কনস্ট্রাকশন (৩৭১/১, স্টেশন রোড, মাঝিরঘাট, সদরঘাট, চট্টগ্রাম)। প্রতিষ্ঠানটি বিধিবহির্ভূতভাবে সিপিসি সুবিধা নেয়ার মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে তথ্য পায় কাস্টমস গোয়েন্দা। কাস্টমস গোয়েন্দার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের একটি দল প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের বিআইএন সনদে যে ঠিকানা দেয়া হয় সেই ঠিকানায় প্লানেট কনস্ট্রাকশন নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ওই ঠিকানায় মেসার্স নাসির ব্রাদার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গোয়েন্দা দল, ভ্যাট বিভাগ থেকে প্রতিষ্ঠানের মূসক রিটার্ন (দাখিলপত্র), উপকরণ উৎপাদ সহগ (মূসক ৪.৩) সংগ্রহ করা হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা (সানি টাওয়ার, ৪র্থ তলা, ২৯১ সিডিএ এভিনিউ, লালখান বাজার, চট্টগ্রাম) দেয়া আছে। সেই ঠিকানায় গোয়েন্দা দল পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পায়নি।
আরও বলা হয়, গোয়েন্দা দল ভ্যাট আগ্রাবাদ বিভাগ থেকে জানতে পারে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক ঠিকানা পরিবর্তনের আবেদন করেছে। যাতে ঠিকানা দেয়া হয়েছে ৫৭০ স্ট্যান্ড রোড, মাঝির ঘাট, সদর ঘাট, চট্টগ্রাম। এ ঠিকানায় গোয়েন্দা দল গিয়ে দেখতে পায়, দেয়ালে প্রতিষ্ঠানের একটি পোস্টার সদৃশ সাইনবোর্ড সাঁটানো। ১০০-১২০ বর্গফুটের একটি অফিস কক্ষ। যাতে একটি টেবিল ও একটি চেয়ার রয়েছে। কিন্তু উৎপাদনে ব্যবহƒত কোনো প্ল্যান্ট, মেশিনারিজ বা কনস্ট্রাকশন সংশ্লিষ্ট কোনো জিনিসপত্র নেই। প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সে ইস্যু হয়েছে ২০২১ সালের ১৯ জুলাই। যাতে ব্যবসার ধরন বলা হয়েছে প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। আর ভ্যাট অনলাইনে যে ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তাতে ব্যবসার ধরন বলা হয়েছে প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার ও উৎপাদনকারী। একই তারিখে ইস্যু করা ট্রেড লাইসেন্সে ব্যবসার দুই ধরন, যা সন্দেহজনক। আবার ট্রেড লাইসেন্সে প্রতিষ্ঠান নিজেকে উৎপাদনকারী দাবি করলেও ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুর প্রায় ৬ মাস পর উৎপাদনকারী হিসেবে মূসক নিবন্ধন নিয়েছে। নিবন্ধন গ্রহণের পর প্রতিষ্ঠান আগ্রাবাদ বিভাগে মূসক-৪.৩-তে ‘কনক্রিট রেডিমিক্স’ উৎপাদিত হচ্ছে উল্লেখ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান রেডিমিক্স উৎপাদন করে না। প্রতিষ্ঠান ‘স্টিম কোল, লাইন স্টোন, ব্রোকেন বা ক্রাশ স্টোন’ সরাসরি আমদানি করে সরবরাহ করে, উৎপাদন করে না।
প্রতিষ্ঠানের চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মূসক রিটার্ন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠান ‘স্টিম কোল, লাইন স্টোন, ব্রোকেন বা ক্রাশ স্টোন’ আমদানি করে সরাসরি বিক্রি করে। এতে প্রমাণিত হয়, প্রতিষ্ঠানটি সিপিসি সুবিধায় আমদানি করা পণ্য কোনোরূপ প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই সরাসরি ফিনিশড গুডস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। যদিও প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনকারী হিসেবে সিপিসি সুবিধা নিয়েছে, যা বিধিবহির্ভূত। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যার হতে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্লানেট কনস্ট্রাকশন ২০২২ সালে ২৫টি ও ২০২৩ সালে ২৩টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে লাইন স্টোন, ব্রোকেন বা ক্রাশ স্টোন, কোল ও মেশিনারিজ যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় সিপিসি-২২০/সি-১৩, সিপিসি-৪০১ ও সিপিসি-এ৬৮ সুবিধায় পণ্য আমদানি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্লানেট কনস্ট্রাকশন সিপিসি-এ৬৮ সুবিধায় (রেগুলেটরি ডিউটি ৩০ শতাংশের পরিবর্তে শূন্য সুবিধায়) চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ১০টি চালানে ক্রাশ লাইম স্টোন আমদানি করেছে। যাতে শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে ১১ কোটি ৭৯ লাখ ৫৪ হাজার ১৭৯ টাকা। সিপিসি-৪০১ (কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ) সুবিধায় ২০২২ সালের জুন মাসে তিনটি চালানে লাইম স্টোন আমদানি করেছে। যাতে শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে ২২ লাখ ৩৩ হাজার ৫৯৮ টাকা। সিপিসি-২২০/এ১৩ সুবিধায় (অগ্রিম কর ও আগাম কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে শূন্য) ২০২২ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৮টি চালানে মেশিনারিজ (ব্যবহƒত এক্সস্ক্যাভেটর) আমদানি করেছে, যাতে শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে দুই কোটি ৯৬ লাখ ৮ হাজার ৪৪৯ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সিপিসি-এ৬৮ প্রাপ্যতা সংক্রান্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের ১৩ মার্চ জারি করা এসআরও এর শর্তানুযায়ী, আমদানিকারক সিপিসি-এ৬৮ বলা হয়েছে, আমদানিকারককে ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইআরসি হোল্ডার ভ্যাট কমপ্লায়েন্ট উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান হতে হবে। নিয়মিত অনলাইনে মূসক রিটার্ন দাখিল করতে হবে। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি শুধু দেয়ালে সাঁটানো নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠান। শুধু সাইনবোর্ড ছাড়া উৎপাদনকারী হিসেবে কোনো প্লান্ট, মেশিনারিজ ও স্থাপনা নেই। সেহেতু প্রতিষ্ঠান সিপিসি-এ৬৮ সুবিধা গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। একইসঙ্গে সিপিসি-৪০১ ও সিপিসি-২২০/সি-১৩ পেতে হলেও এসআরও-তে একই শর্ত দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান নামসর্বস্ব, প্লান্ট, মেশিনারিজ ও স্থাপনা না থাকায় এই দুইটি সিপিসি সুবিধা গ্রহণ করারও কোনো সুযোগ নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের মূসক রিটার্ন, উপকরণ উৎপাদ সহগ, ট্রেড লাইসেন্স, বিল অব এন্ট্রি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি সিপিসি সুবিধা নিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে উৎপাদনকারী হিসেবে নিবন্ধন নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব ও কার্যক্রম নেই। কেবল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ছদ্মনামে সিপিসি সুবিধা ভোগ ও শুল্ককর ফাঁকি দিতে উৎপাদনকারী হিসেবে নিবন্ধন নিয়েছে। আমদানি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনকারী হিসেবে সিপিসি সুবিধা নিয়ে ২০২২ সালের মে থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৪ মাসে মোট ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৯৬ হাজার ২২৬ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। কাস্টমস আইন অনুযায়ী ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায় করতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে অনুরোধ করা হয়।
অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করেন মেসার্স প্লানেট কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান ভূঁইয়া। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা আমাদের ঠিকানা নিয়ে একটা তদন্তে এসেছে। কোনো মামলার প্রতিবেদন বিষয়ে আমার কাছে তথ্য নেই। আমাদের ঠিকানা পরিবর্তন হয়েছে, সেই ঠিকানায় প্রতিষ্ঠান পায়নি। প্রতিবেদনে ১৪ মাসে আমদানি পণ্যে অবৈধভাবে সিপিসি সুবিধা নেয়া হয়েছে বলা হয়েছে। শর্তানুযায়ী প্ল্যান্ট, মেশিনারিজ ও স্থাপনা থাকতে হয়। কিন্তু আপনাদের তা নেইÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের সব আছে। ঠিকাদারের প্ল্যান্ট, মেশিনারিজ এক জায়গায় থাকে না। প্রকল্প যেখানে প্ল্যান্ট, মেশিনারিজ সেখানে চলে যায়। অফিস ঠিকানায় কি প্ল্যান্ট, মেশিনারিজ থাকে? সেটা অনুসন্ধান না করে যদি শুল্ক গোয়েন্দা নিজে নিজে রিপোর্ট দেয়, আমার কাছে যখন আসবে তখন আমি উত্তর দেবো। শুল্ক গোয়েন্দা কারও ইন্ধনে প্রকল্পে না গিয়ে আমার অফিসে গিয়ে একটা রিপোর্ট করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ভ্যাট থেকে আমাদের তথ্য দিয়েছে। আমরা তার বর্ণনা দিচ্ছি। এটা ভ্যাটের ইস্যু, কাস্টমসের নয়। আমাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, আমরা শতভাগ সিপিসি সুবিধা পাই। তিনি বলেন, আমরা উৎপাদনকারী হলাম সরকারি ঠিকাদারি পর্যায়ে। আমরা সরকারের কাছে অর্ডার সেল করি। এসআরও এর শর্তের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাকে নিবন্ধন দেয় বিডা। কাস্টমসের এখানে কোনো এখতিয়ার নেই। কাস্টমস হলো এক্সিকিউট পারসন।