রেলের ‘কালো বিড়াল’দের থামানো দরকার

রেজাউল করিম: রেলের কালো বিড়ালের কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। কালো বিড়ালের কথা উঠলেই আলোচনায় আসেন সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তখন তিনি রেলওয়েতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, রেলওয়েতে কালো বিড়াল রয়েছে এবং তা খুঁজে বের করা হবে।  পরের বছরের ৯ এপ্রিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস এবং রেলের দুজন কর্মকর্তাকে বহন করা গাড়ি বড় অঙ্কের টাকাসহ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির সদও দপ্তরে ঢুকে পড়ে। বিজিবির সদর দপ্তর পিলখানার মূল ফটকে বিপুল অঙ্কের টাকাসহ রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর কমাড্যান্ট এনামুল হক আটক হন। তারা দাবি করেন, তারা এই টাকা নিয়ে রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। এই ধরনের স্বীকারোক্তির পর সন্দেহ আর অভিযোগের অঙ্গুলি মি. সেনগুপ্তের দিকে ওঠে। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল এ অভিযোগের ভিত্তিতে দপ্তর থেকে পদত্যাগ করেন মন্ত্রী। এটা গেল বড় কর্তার বিষয়। অফিস থেকে রেললাইন পর্যন্ত প্রতিটা পদক্ষেপে রেলের অনিয়ম সমালোচনায় ওঠে।

গত ৫ মে পাবনার ঈশ্বরদী রেল জংশন থেকে টিকিট ছাড়া ট্রেনে ওঠেন ‘রেলপথমন্ত্রীর আত্মীয়’ পরিচয়দানকারী তিন যাত্রী। টিকিট না কাটলেও তারা রেলের এসি কেবিনের সিট দখল করেন। এতে রেলের ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) তাদের জরিমানা করেন। পরে ‘রেলপথমন্ত্রীর আত্মীয়’ পরিচয়দানকারী ওই তিন যাত্রী তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করা হয় বলে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। এতে ওই রাতেই ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) শফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে রেল কর্তৃপক্ষ। প্রথমে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণকারী সেই ৩ যাত্রীকে আত্মীয় হিসেবে অস্বীকার করেন। টিটিই বরখাস্তের পেছনে তার স্ত্রীর সম্পৃক্ততা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সরাসরি ইউটার্ন নিলেন রেলমন্ত্রী। নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে বিনা টিকিটে ভ্রমণকারী সেই যাত্রীদের আত্মীয় হিসেবে মেনে নেন রেলমন্ত্রী। অতঃপর তদন্ত কমিটির তদন্তে নির্দোষ প্রমাণ হওয়ায় শফিকুল ইসলামকে চাকরিতে পুনঃবহাল রাখেন।

২০১৯ সালের ২৩ জুন রোববার রাত ১২টার দিকে মৌলভীবাজারের কুলাউরায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের দুটি বগি লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খালে পড়ে। লাইনচ্যুত হয় আরও তিনটি বগি। এ সময় ৭ জন যাত্রী মারাও যান। ফারার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট উদ্ধার কাজে করায় ২০ ঘণ্টা পর ওই রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। পরদিন বড়ছড়া ব্রিজের নিচে পড়ে থাকা আরেকটি বগি উদ্ধার করতে ফের ৭ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এমন দুর্ভোগ নতুন কিছু না। প্রায়ই নজরে পড়ছে। এরপর নিয়মিত আয়োজন। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন হয়। এদিকে রেল সচিব মো. মোফাজ্জল হোসেন ও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, মন্ত্রিপরিষদের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সবাই বললেন মানুষ হুমড়ি খেয়ে রেলে উঠে। তাই এই দুর্ঘটনা। রেল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে থাকা মানুষদের কাছ থেকে আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য জাতির প্রত্যাশা ছিল। এ ঘটনার পর সংবাদকর্মীরা নিজ উদ্যোগেই রেললাইন পর্যবেক্ষণ করে। সংবাদকর্মীদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে রেল দুর্ঘটনা হওয়ার মতো নানা অব্যবস্থাপনা। রেললাইনের বিভিন্ন সংযোগে নাটের পরিবর্তে বাঁশে গোজ লাগিয়ে রাখার ছবি বা সংবাদ প্রকাশ হয়। কাঠের পাটাতনের পরিবর্তে বাঁশের খণ্ড ফেলে রাখার সংবাদও পাচ্ছিলাম। রেললাইনে লোহার লম্বা পাত অনায়াশে নাড়ানো যাচ্ছিল। লাইনের এমন অব্যবস্থাপনা কি রেল দুর্ঘটনার জন্য যথেষ্ট না?

 রেলমন্ত্রীরা প্রায়ই বললেন, মানুষ হুমড়ি খেয়ে রেলে উঠেন বলে দুর্ঘটনা হয়। এর মানে রেলে পর্যাপ্ত যাত্রী হচ্ছে। বাস্তবেও তাই। রেলে উঠতে প্রায়ই আগাম টিকিট কাটতে হয়। মাঝে মধ্যেই দেখতে হয় টিকিট নেই। প্রশ্ন হচ্ছে হুমড়ি খেয়ে রেলে উঠলে সরকারের লাভবান এই খাতে লোকসান কেন হচ্ছে? ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের নিট লোকসান ছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৯৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ওই অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ২৮৯ কোটি ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। আর ব্যয় ছিল ৩ হাজার ১৪২ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের ১০ জুন জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সংসদ সংসদ মামুনুর রশীদের প্রশ্নের জবাবে ওই সময়ের রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক এ তথ্য জানিয়েছিলেন। যাত্রী তো কম ছিল না। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যাত্রী ছিল ৬ কোটি ৪৯ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৬ কোটি ৭৩ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭ কোটি ৮০ হাজার এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যাত্রী ছিল ৭ কোটি ৭৮ লাখ। তাহলে কি তদারকির অভাব?

আসা যাক দুর্ঘটনায়। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব অংশ টাঙ্গাইল  থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইনের ১৭৬ কিলোমিটার সড়কে ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত বছরে এই রেললাইনে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার ৭ জন। ট্রেনে কাটা পড়া ও ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়াকেই এসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে পুলিশ। ঢাকা রেলওয়ে থানা ২০১৪ সালে ৩১৮ জন মারা যায়। ২০১৫ সালে ২৮৫ জন, ২০১৩ সালে ৩০৫ জন, ২০১২ সালে ৩০৬ জন, ২০১১ সালে ২১৫ জন ও ২০১০ সালে ২০৩ জন মানুষ ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায়। এছাড়া বাংলাদেশে রেল পুলিশের হিসেবে ২০১৬ সালে সারাদেশে এক হাজার মানুষ রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যায়। ২০১৭ সালে সারাদেশে ট্রেনে কাটা পড়ে দুই হাজার ১০০ লোকের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনা কিন্তু কমছে না। বরং বাড়ছে। বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে।

রেলওয়ে আইন ১৮৯০ সালের। এ আইনে রেল চলাচলের জন্য পূর্ণ দিকনির্দেশনা দেয়া আছে। রেললাইনের আশপাশে যেন কোনো অবৈধ স্থাপনা না উঠতে পারে, এ জন্য কার্যকর আছে রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) অধ্যাদেশ ১৯৭৯। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৭৬ অনুযায়ী রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। রয়েছে রেল পুলিশ (জিআরপি)। ১৮৯০ সালের রেল আইনে রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুটের মধ্য দিয়ে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ। এমনকি এর মধ্যে গরু-ছাগল ঢুকে পড়লে সেটিকেও নিলামে বিক্রি করে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের। রেলে কাটা পড়ে কেউ আহত হলে উল্টো ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধেই মামলা করতে পারে রেলওয়ে। এতসব কঠোর নিয়ম থাকার পরও প্রতিবছর এত মৃত্যু কেন?

জমি সাশ্রয়ের দিক থেকেও সড়কের চেয়ে রেলপথ বেশি উপকারী। পাঁচটি বড় বাসের যাত্রী একটি ট্রেনে চলাচল করতে পারে। সাশ্রয়ী হওয়ায় পরিবহন হিসেবে গণমানুষের একান্ত নিজের পরিবহন হয়ে উঠেছে ট্রেন। এরকম মহা-উপকারী একটি পরিবহন খাত বছরের পর বছর ক্ষয় হচ্ছে অবহেলা, গাফিলতি আর দুর্নীতিতে। রেল বিভাগে কালো বিড়াল চেপে বসেছে। এই ভূতটাকে সরানো জরুরি। অথচ এ খাতে মনোযোগ দিলে ও যতœ নিলে দেশবাসীর মূল্যবান অর্থ ও সময় যেমন সাশ্রয় হতো, যাতায়াত যেমন আরামদায়ক ও নিরাপদ হতো, তেমনি দেশও হতে পারত পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সমৃদ্ধ এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান। তবে এই কালো বিড়ালটি রেল থেকে নামবে কবে?

সংবাদকর্মী, টাঙ্গাইল

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০