ইসমাইল আলী: চীনের অর্থায়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রেলওয়ে। এর মধ্যে দুটি প্রকল্পে প্রায় চার হাজার ৮৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় চিহ্নিত করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। তাই এ ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১২ সেপ্টেম্বর এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেন তিনি। তবে ব্যয় কমাতে গিয়ে জটিলতার সম্মুখীন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কারণ নির্মাণ ব্যয় কমাতে হলে ঠিকাদারের সঙ্গে নতুন করে দরকষাকষি করতে হবে।
যদিও ঠিকাদারের সঙ্গে দরকষাকষির জন্য নতুন কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে। এছাড়া ব্যয় কমানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে পৃথক কারিগরি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে ব্যয় কমাতে ঠিকাদার রাজি না হলে প্রকল্প দুটি বাতিল হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল রেলভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ ধরনের মন্তব্য করা হয়।
তথ্যমতে, অতিরিক্ত ব্যয় চিহ্নিতকৃত প্রকল্প দুটি হলো আখাউড়া-সিলেট মিটারগেজ রেলপথকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর এবং জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা। প্রকল্প দুটির ব্যয় কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন ও কমিটির সুপারিশসহ সার্বিক বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে।
এতে বলা হয়, প্রকল্প দুটির ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নি¤œরূপ সদয় অনুশাসন প্রদান করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ক. আখাউড়া-সিলেট প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় থেকে তিন হাজার ৩৫৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা (২০.৮%) কমে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করতে হবে এবং খ. জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী প্রকল্পের ক্ষেত্রে কমিটি কর্তৃক নির্ধারণকৃত অনুমোদিত দরমূল্য থেকে এক হাজার ৪৯৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা (১২.৯১%) কমের বিষয়সহ সার্বিক বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রকল্পটি সংশোধন করতে হবে।
সূত্রমতে, চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য উল্লিখিত প্রকল্প দুটিতে কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই নিয়োগ করা হয় ঠিকাদার। এক্ষেত্রে দুই পক্ষের দরকষাকষির ভিত্তিতে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে প্রকল্প দুটির অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সম্প্রতি তা যুক্তিযুক্তকরণে কমিটি গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ওই কমিটি প্রকল্প দুটির ব্যয় পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন পেশ করে। পাশাপাশি প্রকল্প দুটির অতিরিক্ত ব্যয়ও চিহ্নিত করা হয়। এর ভিত্তিতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ।
তথ্যমতে, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ২৩৯ দশমিক ১৪ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তরে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ১০৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। গত বছর এপ্রিলে প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। এ প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মাটির কাজে ৩৪৬ কোটি ২৮ লাখ, ট্র্যাকের কাজে ১৯২ কোটি ৫৭ লাখ, সিগন্যাল ও টেলিকম খাতে ২১ কোটি ৬১ লাখ, সেতু ও কালভার্ট খাতে ১৪৬ কোটি ৪৬ লাখ, স্টেশন ও বিল্ডিং খাতে ২০ কোটি ৩৩ লাখ এবং প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতে এক হাজার ৩৮২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয় কমানো হয়েছে।
এদিকে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন ডুয়েলগেজ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৯৮ দশমিক ২৯ কিলোমিটার। এ রেলপথ নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৫৮৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ হাজার ৯১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মাটির কাজে ১৪৩ কোটি ৩৬ লাখ, ট্র্যাকের কাজে ১২৭ কোটি ৫৩ লাখ, সিগন্যাল ও টেলিকম খাতে তিন কোটি ৬১ লাখ, সেতু ও কালভার্ট খাতে ১৫১ কোটি ২৫ লাখ, স্টেশন ও বিল্ডিং খাতে ১১ কোটি ৪৭ লাখ এবং প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতে এক হাজার ৮৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় কমানো হয়েছে।
গতকাল রেলভবনে অনুষ্ঠিত ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ কমিটির বৈঠকে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, আখাউড়া-সিলেট প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুসারে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের বিষয়টি অপরিবর্তিত রাখতে প্রস্তাবিত ব্যয় প্রাক্কলন পুনর্নির্ধারণ করা যেতে পারে। অথবা রেলওয়ের মাস্টারপ্ল্যান ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুসরণে জিটুজি ভিত্তিতে একই অর্থায়নে মিটারগেজ রেলপথের পাশে নতুন ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে জিটুজি কর্তৃপক্ষের সম্মতি ইআরডির (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) মাধ্যমে জানা আবশ্যক।
এদিকে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন ডুয়েলগেজ প্রকল্পের ক্ষেত্রে কারিগরি কমিটি জানায়, যেহেতু সিসিজিপি কর্তৃক নির্মাণকাজের দরপত্র অনুমোদিত হয়েছে, সেহেতু সিসিজিপির দরমূল্য বহাল রাখা যেতে পারে।
জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সদস্য জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্প দুটির ব্যয় কমানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া খুব সহজ নয়। কারণ দরকষাকষি হয়েছে বছর দুয়েক আগে। এখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দর কমিয়ে কাজ করতে রাজি নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রকল্প দুটি বাতিল হয়ে যেতে পারে অথবা চীনের অর্থায়নও বন্ধ হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে প্রকল্প দুটির বিষয়ে পরবর্তী সময়ে করণীয় নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর মতামত চাওয়া হবে।