রেলে পণ্য পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশ সংসদীয় কমিটির

ইসমাইল আলী: সারাদেশে পরিবহনকৃত পণ্য ও কনটেইনারের মাত্র দুই থেকে তিন শতাংশ রেলপথে বহন করা হয়। যদিও গত কয়েক বছরে বিশেষ করে করোনাকালে রেলপথে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে পণ্য পরিবহন খাতে রেলের আয়ও বেড়েছে। তারপরও পণ্য পরিবহনে বড় ধরনের লোকসান দিচ্ছে রেলওয়ে। এজন্য রেলপথে পণ্য পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে রেলপথে পণ্য পরিবহনে আয়-ব্যয় জানতে চাওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়ে জানায়, ট্রেনে পণ্য পরিবহনে টনপ্রতি কিলোমিটারে ব্যয় আট টাকা ৯৪ পয়সা। আর আয় মাত্র তিন টাকা ১৮ পয়সা। এতে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারে রেলের লোকসান হয় পাঁচ টাকা ৭৬ পয়সা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে রেলপথ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিপুল এ ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে পণ্য পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনার সুপারিশ করে। এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর ট্রেনে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়। কমিটি ভাড়া বৃদ্ধির পক্ষে মতামত দেন। তবে প্রধানমন্ত্রী ভাড়া বৃদ্ধির বিপক্ষে ছিলেন।

তিনি আরও বলেন, এবারও পণ্য পরিবহনে ট্রেন ভাড়া বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে প্রধানমন্ত্রী আপত্তি করতে পারেন। তাই আগেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক সম্মতি দিলে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০২০ সালে ট্রেনের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন না পাওয়ায় সেবারও তা কার্যকর করা যায়নি। সে সময় যাত্রীর পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের জন্য নির্ধারিত ১৪টি শ্রেণির সবগুলোতেই ২০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। পাশাপাশি অন্যান্য চার্জ, যেমনÑসাইডিং চার্জ (স্টেশন ওয়াইজ), টার্মিনাল চার্জ, ট্রানশিপমেন্ট চার্জ, শর্ট ডিসটেন্স চার্জ, পয়েন্ট চার্জ, অ্যাডিশনাল হলেজ চার্জ, সারচার্জ কাস্টম, এক্সামিনেশন ফি ইত্যাদিও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়।

সে সময় ট্রেনে পার্সেল খাতেও ২০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে সব চার্জ ও লেভি যথা টার্মিনাল চার্জ, স্পেশাল হলেজ চার্জ, হোয়ারফেজ চার্জ ইত্যাদি ভাড়া সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া সব ধরনের সবজি, ফলমূল ও ডিম পরিবহনে ভাড়ার ওপর প্রদত্ত ২৫ শতাংশ ছাড় প্রত্যাহার করে ভাড়া সমন্বয়ের সুপারিশ করা হয়।

এদিকে পণ্য ও পার্সেলের পাশাপাশি কনটেইনার পরিবহন ভাড়াও বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিল কমিটি। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী আমদানিকৃত পণ্যের কনটেইনার পরিবহন ভাড়া ২০ শতাংশ বৃদ্ধি এবং ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী রপ্তানিমুখী পণ্যের কনটেইনার পরিবহনে বিদ্যমান ছাড় ২৫ শতাংশ হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পাশাপাশি খালি কনটেইনার পরিবহন ভাড়াও একই হারে বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়।

এতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী ২০ ফুটের কনটেইনার পরিবহন ভাড়া (১৫ টন পর্যন্ত) ৯ হাজার ৭০০ টাকা বাড়িয়ে ১১ হাজার ৭০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। একইভাবে ২০ ফুটের কনটেইনারে ১৫-২০ টন পরিবহনে ভাড়া ১২ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা, ২০-২৫ টন পরিবহনে ১৪ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১৭ হাজার ৪০০ টাকা এবং ২৫ টনের ঊর্ধ্বের ভাড়া ১৬ হাজার ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী ২০ ফুটের কনটেইনার পরিবহন ভাড়া (১৫ টন পর্যন্ত) চার হাজার ৯০০ টাকা বাড়িয়ে আট হাজার ৭৭৫ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। একইভাবে ২০ ফুটের কনটেইনারে ১৫-২০ টন পরিবহনে ভাড়া ছয় হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১১ হাজার ৬২৫ টাকা, ২০-২৫ টন পরিবহনে সাত হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১৩ হাজার ৫০ টাকা এবং ২৫ টনের ঊর্ধ্বে আট হাজার ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৫৫০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।

অপরদিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী ৪০ ফুট কনটেইনারে ৩০ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন ভাড়া ১৬ হাজার ১০০ টাকা বাড়িয়ে ১৯ হাজার ৪০০ টাকা এবং ৩০ টনের ঊর্ধ্বে ভাড়া ২২ হাজার ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী ৪০ ফুট কনটেইনারে ৩০ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন ভাড়া আট হাজার ১০০ টাকা বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৫৫০ টাকা এবং ৩০ টনের ঊর্ধ্বে ভাড়া ১১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।

এর বাইরে ২০ ফুটের খালি কনটেইনার পরিবহন ভাড়া তিন হাজার ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে চার হাজার ৬০০ টাকা ও ৪০ ফুটের খালি কনটেইনার ভাড়া পাঁচ হাজার ৯০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাত হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।

রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সড়কপথে কনটেইনার ও পণ্য পরিবহন ভাড়া অনেক বেশি। তবে ট্রেনে এ সার্ভিসটি জনপ্রিয় করতে সবসময়ই ভাড়া কম রাখা হয়। এছাড়া রপ্তানিমুখী কনটেইনার পরিবহন ভাড়ায় ৫০ শতাংশ ছাড়ও দেয়া হয়। তবে তেলের দাম বৃদ্ধির পর সড়কপথে ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। তাই রেলপথে এ ভাড়া ২০-২৫ শতাংশ বাড়ানো উচিত।

তারা আরও বলেন, সাধারণত বিশ্বের সব দেশেই পণ্য পরিবহনে মুনাফা থেকে যাত্রী পরিবহনে ভর্তুকি দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পণ্য পরিবহনেই লোকসান করছে রেলওয়ে। তাই ভাড়া বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংসদীয় কমিটিও ইতিবাচক সুপারিশ করেছে। তাই রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্রুত বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করা।

উল্লেখ্য, গত অর্থবছর ট্রেনে পণ্য পরিবহন কমেছে। পাশাপাশি এ খাতে আয়ও অনেকটা কমেছে। ২০২০-২১ অর্থবছর পণ্য পরিবহন খাতে রেলের আয় ছিল ৪০৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর তা দাঁড়িয়েছে ৩৫৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এ সময় রেলপথে ৫৩ লাখ ১৩ হাজার টন পণ্য পরিবহন করা হয়। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছর ৫৪ লাখ ৪৫ হাজার টন পণ্য পরিবহন করেছিল রেল। মূলত করোনার সময় ভারত থেকে রেলপথে পণ্য পরিবহন বেশি হয়েছিল। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে অক্সিজেন স্পেশাল ট্রেনও পরিচালনা করা হয়। এর প্রভাবেই পণ্য পরিবহন আয় বেড়েছিল।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০