Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 3:46 am

রোগটির নাম ডাউন সিনড্রোম

ডা. খুরশীদা খন্দকার: ডাউন সিনড্রোম হলো এক ধরনের ক্রমোজোমাল ডিজঅর্ডার। প্রতিটি মানুষ ২৩ জোড়া ক্রোমোজম বহন করে। যার অর্ধেক আসে মায়ের কাছ থেকে। বাকি অর্ধেক পায় বাবার কাছে। কোটি কোটি ‘ডিএনএ’ এর সমন্বয়ে এক একটি ক্রোমোজম গঠিত হয়।

ডিএনএ হচ্ছে বংশগতির ধারক ও বাহক। আমাদের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য যেমন আচার, আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রঙ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ডিএনএ। মানবদেহে ডিএনএ বা ক্রোমোজমে অসামঞ্জস্য দেখা দিলে নানারকম শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি দেখা দেয়, যাদের আমরা সাধারণভাবে জন্মগত ত্রুটি বা জেনেটিক ফল্ট বলি।

ডাউন সিনড্রোম বা ডাউন শিশু এমনি একটি জেনেটিক ত্রুটিযুক্ত শিশু। যার শরীরের প্রতিটি কোষে ২১ নং ক্রোমোজমটির সঙ্গে আংশিক বা পূর্ণভাবে ট্রিজোমি-২১ নামে আর একটি ক্রোমোজম থাকে। অতিরিক্ত এ ক্রোমোজমের কারণে শিশুর মধ্যে কিছু শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। এ ত্রুটি তাদের চেহারায় প্রকাশ পায়। তাই সহজে ডাউন শিশুকে চেনা যায়।

ডাউন সিনড্রোম শিশুর মধ্যে কিছু জটিলতা দেখা যায়। যেমন মাংশপেশির শিথিলতা, কম উচ্চতা, চোখের কোনা ওপরের দিকে ওঠানো, চ্যাপ্টা নাক, ছোট কান, হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা থাকা, জিহ্বা বের হয়ে থাকা প্রভৃতির মাধ্যমে ডাউন শিশু চেনা যায়। এ ধরনের শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে একটু দেরিতে বেড়ে ওঠে।

এ রোগে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে জন্ম গত হার্টের সমস্যা থাকে। এ কারণে অনেক শিশু জন্ম পর মারা যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে হার্টে অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে। তাদের অনেকে লিউকোমিয়া, থাইরয়েডে আক্রান্ত হয়। দেখা ও শোনার সমস্যায় ভোগে অনেকে। কেউ কেউ পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, জীবাণু সংক্রমণ, শারীরিক স্থূলতা প্রভৃতি জটিলতায়ও ভুগতে পারে। এদের গড় আয়– সাধারণত অন্যদের তুলনায় কম হয়।

ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাংডন ডাউন ১৮৬৬ সালে এ শিশুদের চিহ্নিত করেন। তার নামানুসারে ডাউন সিনড্রোম নাম রাখা হয়। তবে ১৯৫৯ সালের আগে রোগটি যে ক্রমোজোম সংক্রান্ত তা নিয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ অধিক বয়সে মা হওয়াকে এ রোগের কারণ বলে দাবি করেছেন। নিউইয়র্কের ন্যাশনাল ডাউন সিনড্রোম সোসাইটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০ বছর বয়সী প্রতি দুই হাজার মায়ের মধ্যে একজন ডাউন শিশুর জন্ম দেন। ২২ বছর বয়সী ১৫০০ মায়ের ক্ষেত্রে একজন, ২৫ বছর বয়সী ১২০০ মায়ের একজন, ৩০ বছর বয়সী ৯০০ মায়ের একজন, ৩৫ বছর বয়সী প্রতি ৩৫০ মায়ের মধ্যে একজন, ৪০ বছর বয়সী প্রতি ১০০ মায়ের মধ্যে একজন ও ৪৯ বছর বয়সী ১০ জন মায়ের মধ্যে একজন ডাউন শিশু জন্ম দেন।

এ কারণে ৩৫ বছরের অধিক বয়সে মা হতে নিরুৎসাহিত করা হয়। মায়ের বয়স ছাড়াও পরিবেশ দূষণ, গর্ভবতী মায়ের ভেজাল খাদ্য গ্রহণ, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণেও ডাউন শিশুর জন্ম হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। অনেক সময় বাবা-মা ত্রুটিযুক্ত ক্রোমোজমের বাহক হলে তাদের সন্তানও ডাউন শিশু হতে পারে।

ডাউন সিনড্রোম থেকে মুক্তির কোনো চিকিৎসা নেই। তবে সচেতনতা এ ধরনের রোগাক্রান্ত শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করতে পারে। সন্তান ডাউন কিনা তা গর্ভাবস্থায় নিশ্চিত করা যায়। একজন প্রসূতি মা কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিংয়ের মাধ্যমে গর্ভাবস্থার ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চার ডিএনএ পরীক্ষা করে অনাগত সন্তানের শারীরিক অবস্থা জেনে নিতে পারে। আবার ১৫ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের বাচ্চার চতুর্দিকে থাকা তরল বা অ্যামনিওসেন্টেসিস সংগ্রহ করে পরীক্ষার মাধ্যমে বাচ্চা ডাউন কি-না তা নিশ্চিত করতে পারে।

ডাউন শিশু সাধারণত শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হয়। তাই পরিবারে সন্তান জন্মের পরিপ্রেক্ষিতে আনন্দের বদলে হতাশা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মনে রাখা উচিত, ডাউন শিশু পরিবার বা সমাজের জন্য বোঝা নয়। ওরা পরিবার ও সমাজেরই অংশ। তাদের হাসিখুশি রাখা উচিত। সুন্দর ও আন্তরিক ব্যবহার তাদের জীবনকে আনন্দঘন করে তুলতে পারে।

চিকিৎসক
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল