বীর সাহাবী : ডেঙ্গুর প্রকোপ দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিভিন্ন ভাইরাস জ্বর। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু ও ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়ছে আইভি ফ্লুইড বা স্যালাইনের। চাহিদা অনুযায়ী বাজারে স্যালাইনের সরবরাহ কম রয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছেমতো দাম নেয়া হচ্ছে। ৮৮ টাকার স্যালাইন সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন রোগীরা। স্যালাইন সংকট থাকলেও রোগীদের ‘জিম্মি’ করে বেশি দাম নিচ্ছে ফার্মেসিগুলো। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিগুলো চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন সরবরাহ করছে না। যদিও কোম্পানিগুলোর দাবি, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে তিনগুণ উৎপাদন করা হচ্ছে। ফার্মেসিতে আগের দামেই বিক্রি করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তারা।
সরেজমিন, রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশের বেশির ভাগ ফার্মেসিতে দেখা যায়, ১ হাজার মিলিগ্রামের ডিএনএস স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে না। কয়েকটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে, তা-ও চড়া দামে। ১ হাজার মিলিগ্রামের একটি ডিএনএস স্যালাইনের মোড়কে মূল্য কোম্পানিভেদে ৮৮ থেকে ৯১ টাকা (প্লাস্টিকের বোতল) এবং ৫০০ মিলিগ্রামের ডিএনএস স্যালাইন ১২৫ টাকা (কাচের বোতল)। সেখানে দোকানিরা ১ হাজার মিলিগ্রামের স্যালাইন বিক্রি করছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে ৫০০ মিলিগ্রামেরটি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়।
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে এমকে ফার্মেসি, ইমন ফার্মেসি, বীণা ফার্মেসি, কনা ফার্মেসি, ছন্দা ফার্মেসি, মোল্লা মেডিসিন কর্নার, সেন্ট মেরিস ফার্মেসিসহ অন্তত ১০টি ওষুধের দোকান রয়েছে। কোনো দোকানেই ডিএনএস স্যালাইন নেই। তবে প্যাকেটে মুদ্রিত দামের চেয়ে বেশি টাকা দিলে ম্যানেজ করে দিতে পারবে, এই কথা বলে ক্রেতার কাছ থেকে বেশি দাম নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে।
বেশি দাম দিয়ে বাধ্য হয়ে স্যালাইন কিনতে হচ্ছে জানিয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর বাবা জমির উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলেটি দুই দিন ধরে এ হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তার প্রথম দিনেই ডিএনএস স্যালাইনসহ অন্যান্য ওষুধের নাম প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন। আমি বাইরে সব জায়গায় খুঁজেছি, কোনো দোকানেই স্যালাইনটি পাইনি। সবাই বলছে স্যালাইন নাকি শেষ হয়ে গেছে। অথচ অনেককে দেখলাম ১ হাজার মিলির জন্য ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দিলে তারা স্যালাইন ম্যানেজ করে দেয়। কোথা থেকে আনে, জানি না। উপায় না দেখে আমিও ১০০ টাকার স্যালাইন দুটি ৬০০ টাকায় কিনেছি।
পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকার অভিযোগ: ন্যাশনাল হাসপাতালের পাশে এমকে ফার্মেসির কর্মচারী জুয়েল মিয়া বলেন, স্যালাইনের সাপ্লাই নেই। আমরা কোথা থেকে বিক্রি করব? এক সপ্তাহ ধরে এই সংকট তৈরি হয়েছে। আশপাশের কোনো দোকানেই স্যালাইন পাবেন না। আমরা ইমার্জেন্সি রোগী বুঝে মিটফোর্ডের দিক থেকে এনে দিই। আবার রোগীদের আত্মীয়দের বলি, মিডফোর্ড থেকে স্যালাইন কিনে আনতে। কোম্পানি ডিএনএস স্যালাইন সাপ্লাই কম দেয়। সাপ্লাই না দিলে আমরা কীভাবে বিক্রি করব?
বীণা ফার্মেসি ও কনা ফার্মেসির দুই কর্মচারী বলেন, ‘স্যালাইনের সরবরাহ নাই। আমাদের অনেক দূর থেকে নিয়ে আসতে হয়। এ জন্য দাম কিছুটা বেশি রাখতে হচ্ছে। কারণ, কারও না কারও তো লাগবেই। এটা নিয়ে আবার দু’দিন ঝামেলাও হয়েছে। এজন্য এখন আর বিক্রি করি না। কেউ এলে বলি, ‘নাই’। কারও লাগলেও কিছু করার নাই। তবে আশপাশে কয়েকজন লোক আছে, বললে তারা দূর থেকে নিয়ে আসে। এ জন্য তারা বেশি দাম রাখে। এখন যার দরকার হয় সে অল্প আর বেশি দাম হোক, স্যালাইন কিনবেই।’
চাহিদা মেটাতে ৩ শিফটে উৎপাদনে কোম্পানিগুলো: ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও মুখপাত্র নুরুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় আইভি স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে ২০ গুণ। কোম্পানিগুলো আগে এক শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করত। আমরা কোম্পানিগুলোকে তিন শিফটে ও ছুটির দিনও স্যালাইন উৎপাদন করতে বলেছি। এখন দিনে এক লাখ ১০ হাজার বোতল স্যালাইন উৎপাদন করছে কোম্পানিগুলো।
তিনি বলেন, ‘সাতটি কোম্পানি স্যালাইন উৎপাদন করে। শুরুতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় প্রথমে হিমশিম খেতে হয়েছিল। এখন সেই অবস্থা থেকে অনেকটা উন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহƒত ওষুধ, স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ব্যবসায়ীরা যেন বাণিজ্য করতে না পারে সে জন্য ঢাকা শহরের জন্য ৪০ সদস্যের ৮টি মনিটরিং টিম করেছে ডিজিডিএ। কেউ বেশি দাম নিচ্ছেÑএমন তথ্য পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ওষুধ সরবরাহকারী বেসরকারি একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা স্যালাইনসহ অন্যান্য ওষুধের উৎপাদন ঠিক রেখেছি। তারপরও স্যালাইনের সংকট কেন হচ্ছে; এটা জানা নেই। আমাদের দিক থেকে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি এই সংকট কাটিয়ে ওঠার।
পর্যাপ্ত স্যালাইন উৎপাদন ও সরবরাহ থাকলে কেন তাহলে স্যালাইনের দাম বেশি রাখা হচ্ছেÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় একটা চাহিদা তৈরি হয়েছে বাজারে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে হয়তো খুচরা পর্যায়ে দাম বেশি রাখতেই ফার্মেসিগুলো এমন করে থাকতে পারে।’
বেসরকারি কোম্পানি থেকে স্যালাইন কিনছে ইডিসিএল
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান একসময় শিরায় দেয়া স্যালাইন উৎপাদন করত। এ স্যালাইন সরকারি হাসপাতালে ব্যবহƒত হতো। তিন-চার বছর আগে বিকল্প ব্যবস্থা না করেই উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, সরকারের একমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিডেট (ইডিসিএল) শিরায় দেয়া স্যালাইন উৎপাদন করবে। ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক এহসানুল কবির বলেন, ‘আর কয়েক মাসের মধ্যে ইডিসিএলের গোপালগঞ্জ কারখানায় স্যালাইন উৎপাদন শুরু হবে।’
সরকারি হাসপাতালে রোগীরা বিনা মূল্যে স্যালাইন পান। বর্তমানে ইডিসিএল বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে স্যালাইন কিনে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে বলে ইডিসিএলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বেক্সিমকো, স্কয়ার, এক্মি, পপুলার, ওরিয়ন, লিবরা ও অপসোনিনÑএই সাতটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইডিসিএল স্যালাইন কিনছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্যালাইন আমদানি
ডেঙ্গুর এ ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনে স্যালাইন আমদানির নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেছেন, ‘সারাদেশে পাঁচ হাজার বেড রেডি রাখতে বলেছি। এখনও অনেক বেড খালি রয়েছে। স্যালাইনের এখন বিশেষ প্রয়োজন, সারাদেশে যারা স্যালাইন তৈরি করে তাদের বলেছি শত ভাগ উৎপাদনে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ করে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব নয়। প্রতিদিন আমাদের ৪০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন লাগে, সেই ক্ষেত্রে মাসে ১২ লাখ ব্যাগ স্যালাইন লাগে। সব কোম্পানি মিলেও এত উৎপাদন করতে পারে না।’
জাহিদ মালেক আরও বলেন, ‘এজন্য দুদিন আগে আমরা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মিটিং করেছি এবং নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে বিদেশ থেকেও প্রয়োজনে স্যালাইন ব্যাগ আমদানি করতে পারে। হঠাৎ করেই স্যালাইনের চাহিদা বেড়ে গেছে। এ কারণে আমরা বাফার স্টক রাখতে চাই সরকারিভাবে। আমরা নিজেরাও রাখব আর প্রাইভেটকেও দিয়ে দেব। যারা আমদানি করতে চায় তারা এখনই তা করতে পারবে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এখনও ডেঙ্গু বাড়তি রয়েছে, এখন পর্যন্ত সারাদেশে ৮০ হাজার ডেঙ্গু রোগী পেয়েছি। গত বছর কম ছিল, এর আগে একটু বেশি ছিল। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৭৩ জন। আমি মনে করি, এটা অনেক বেশি।’