রোজার পর নিয়ন্ত্রণহীন বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক: রোজার পর আদা কেনা হয়নি মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মো. আজমত উল্লাহর (ছদ্মনাম)। রোজা শুরুর আগে এ পণ্যটি কিনেছিলেন ১২০ টাকা কেজি দরে। গতকাল বাজারে গিয়ে দেখেন, ভালো মানের আদা বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা কেজিতে। রোজাতেও আদা বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা কেজি দরে। এক মাসের ব্যবধানে দাম বেড়ে দেড়গুণ হয়েছে শুনে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।

বিস্মিত আজমত উল্লাহ দোকানিকে জিজ্ঞেস করেন, হঠাৎ কেন দামের এত বৃদ্ধি। দোকানি জানান, পাইকারি বাজারে বেড়েছে; তাই খুচরায় দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাইকারি বাজারে কেন বেড়েছেÑজানতে চাইলে দোকানি বলেন, ‘আমরা আদার বেপারি, জাহাজের খবর রাখি না।’

শুধু আদা নয়, ঈদের পর প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। বাজারে এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণের বেশি। ৩৫ টাকা কেজি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকা কেজিতে। এদিকে আলুর কেজিতেও মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ টাকা। ২৫ টাকা কেজির আলু এখন ৪০ টাকা কেজিতে ঠেকেছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন তথ্য দেখা যায়।

আজমত উল্লাহ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে দেখে আসছি রোজার আগে পণ্যের দাম বাড়ে। রোজার শেষ দিকে বা ঈদের পর তা আবার কিছুটা কমে। তবে এবার ঈদের পর পণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, তা ধারণার বাইরে। এভাবে দাম বাড়লে শুধু ডাল-ভাত খেয়ে দিন পার করতে হবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঈদের পর দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নতুন বলে জানাচ্ছেন বিক্রেতারাও। তবে এর পেছনে পাইকারি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন তারা। খুচরা বাজারের দোকানিরা বলছেন, ‘পাইকারিতে দাম বাড়ায় খুচরা বাজারে এমন প্রভাব পড়েছে। ফলে বেশি দামে কিনে বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে।’

এদিকে কারওয়ান বাজারে আলুর দাম বাড়ার বিষয়ে পাইকারি আড়তদারদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এ বছর আলুর ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি স্টোরেজ কম করায় আলুর দামে প্রভাব পড়েছে। নতুন মৌসুমে আলু আসা পর্যন্ত দাম কমার সম্ভাবনা খুবই কম। উল্টো দাম বাড়তে পারে বলে ধারণা তাদের।

অন্যদিকে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, পেঁয়াজের আমদানি না থাকায় মূলত দাম বাড়ছে। তবে আমদানি শুরু হলে দাম কমতে পারে।

কোরবানি ঈদ উপলক্ষে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে কি নাÑজানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা জানান, ‘ঈদ আসতে এখনও অনেক দেরি। যেখানে প্রতিদিন বাজার ওঠানামা করে, সেখানে ঈদ নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ নেই। দাম বাড়লে এমনিতেই বাড়ে।’

গ্রাহকদের সঙ্গে কথা হলে অনেকটা অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রতিদিন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। দেশে কোনো পণ্যের দাম স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। আগে ৫০০ টাকায় যে বাজার করতাম, একই বাজার করতে এখন দেড় হাজার টাকা চলে যাচ্ছে। বাজারে কোনো নজরদারি নেই।’

রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, খোলা চিনির দাম এক মাসের ব্যবধানে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল ১২০ থেকে ১২৫ টাকা।

এর কারণ হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, পাইকারিতে বেশি দামে চিনি ক্রয় করতে হচ্ছে। আবার চাইলেও চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি বাজারে এক-দু’দিন আগে চিনির বিষয়ে জানিয়ে রাখতে হচ্ছে। এরপরও বেশি দামে চিনি ক্রয় করতে হচ্ছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, তারা চিনি কেনেন যেখান থেকে সেই পাইকারি বাজারে চিনি ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা সে চিনি ১০৫ থেকে ১০৬ টাকায় কিনে থাকেন মিলগেট থেকে। জায়গাভেদে সেই দাম ১১০ থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত হয়। তাহলে গ্রাহক বা ভোক্তা পর্যায়ে গিয়ে চিনির দাম ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। 

চিনির দামের বিষয়ে মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মো. হারুনুর রশীদ বলেন, মিলের কাছে ঠিকমতো চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুটা সংকট দেখানো হচ্ছে বা সাপ্লাই কম থাকায় তারা ঠিকমতো দিতে পারছে না। যে কারণে চাহিদা মতো চিনি পাওয়ায় দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর আমদানিকারকদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি আর ব্যবসায়ী আমদানি করে। তাই আমদানি করা চিনি বেশি দামে কিনতে হয়। মিলের কাছ থেকে পাইকারি যে দামে কেনা যায়, আমদানি করা কোম্পানির কাছ থেকে তার থেকেও ৩-৫ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়। এজন্য আমদানি করা চিনির থেকে মিলের কাছ থেকে কেনার চাহিদা বেশি থাকে বলে জানা যায়।

অপরদিকে তেলের বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে খোলা সয়াবিন তেল কেজিপ্রতি ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

এর অন্যতম কারণ হিসেবে ভোজ্যতেলে সরকারের করের বিষয়টি তুলে ধরেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে তেলের পাইকারি বাজারে দেখা যায়, খুচরা ব্যবসায়ীরা যেখান থেকে তেল কেনেন, সেখানে বর্তমানে খোলা তেল ১৭৫ থেকে ১৮৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। আর বোতলজাত তেল ৫ লিটারের ৯২০ থেকে ৯৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। অপরদিকে মূল পাইকারি দোকানে খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। তবে তাদের ১৭৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রির সুযোগ থাকলেও পাইকারির বাজারে দাম কম থাকায় কমেই বিক্রি করছেন। আর বোতলজাত তেল সেসব দোকানে ৫ লিটারের ৯১০ থেকে ৯১৫ টাকায় বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক পাইকারি ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, মাঝে কর ছাড় শেষ হওয়ায় দাম বৃদ্ধি হতে দেখা গেছে। কিন্তু এখন আবার দাম স্বাভাবিক আছে। আমাদের সমস্যা হয় হঠাৎ দাম বাড়লে আর কমলে। দু’দিন আগেরই এক গাড়িতে ৩০ হাজার টাকা বেশি লেগেছে। যেটা পরে বেশি দামে বিক্রি করে পোষাতে হয়। আবার কবে হঠাৎ করে বেড়ে যাবে বলা যায় না।

গ্রাহক পর্যায়ে বেশি দামের বিষয়ে জানতে চাইলেÑরামপুরার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘সেটার বিষয়ে আমরা বলতে পারব না। তবে এটা পাইকারি ব্যবসায়ীরা করে থাকে। কম দামে কিনেও বেশি দামে বিক্রি করে লাভ বেশি করে থাকে। আবার দাম বেড়ে গেলে তখন সেটা মানিয়ে নেয়। এই সুযোগ পাইকারি ব্যবসায়ীরাই কাজে লাগান।’

আমদানিকারক একাধিক কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ‘বাজারে কয়েকটি কোম্পানি তেল আমদানি করে। এজন্য অনেক সময় দাম বেশি রাখতে হয়। তারা সুযোগ থাকলেও দাম কমান না। বর্তমানে দু-তিনটা কোম্পানি তেলে বেশি কর নিচ্ছে। এর মধ্যে একটা কোম্পানি সবার থেকে বেশি ৬০ টাকা অতিরিক্ত কর নিচ্ছে। এখন তার কাছ থেকে তো আমরা কিনব না। কিন্তু বাধ্য হয়ে তার কাছ থেকে কিনতে হলে তখন তো আমরাও দাম বাড়িয়ে দেব।’

এদিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে চীনা রসুন সাধারণ ৫ কেজির পাইকারি দর ৭০০ টাকা এবং ভালো মানেরটা ৭৫০ টাকা। আর দেশি রসুন ৫ কেজি ৬৫০ টাকা। তবে খুচরা বাজারে দেশি ও চীনা রসুন উভয় বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকায়। এক মাস আগে যার দাম ছিল ১২০-১২৫ টাকা।

কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, রোজার পর রসুনের দাম কিছুটা বেড়েছিল। এখন স্থিতিশীল। ভারতের এলসির রসুন দেশের বাজারে আসার পর দেশি কোয়া রসুনের দাম কমেছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০