Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 6:13 pm

রোবট মিরা…

আধুনিক সভ্যতা বিনির্মাণে তথ্যপ্রযুক্তির বেশ ভূমিকা রয়েছে। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় কাজ করছে আধুনিক বিজ্ঞানের বিচিত্র আবিষ্কার, মানবকল্যাণে যা ব্যবহƒত হচ্ছে। এ ভাবনা থেকেই অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন একদল তরুণ শিক্ষার্থী। বলছিলাম, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছয় শিক্ষার্থীর কথা। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয়েছে একটি রোবট। আনুমানিক ৪৭ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত রোবটটির নাম রাখা হয়েছে ‘মিরা’। মিরার পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে ‘মোবাইল অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্ট রোবট ফর অ্যাডভান্সড অ্যাসিস্ট্যান্স’।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের একটি প্রকল্প রোবট মিরা। এর উদ্ভাবক হলেন ওই বিভাগের ২০তম ব্যাচের ছয় শিক্ষার্থী। দলনেতা মোহাম্মদ রিফাত। দলের অন্য সদস্যরা হলেন মাহতাবুর রহমান সবুজ, মাহমুদা আক্তার নিঝুম, মারুফ হোসেন, সাফিক হাসান ও শারমিন নাহার তোহফা।

চমকপ্রদ এ আবিষ্কারের পেছনের গল্প জানতে চাইলে মোহাম্মদ রিফাত বলেন, এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু তৈরির ব্যাপারটা আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল। ভেবেছিলাম ভার্সিটির ফাইনাল প্রজেক্টে ইউনিক ও ইন্সপায়ারিং একটি প্রজেক্ট উপহার দেব। অ্যাডভান্সড টেকনোলজি নিয়ে পড়ালেখার ওপর আমার আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং ও নিউরাল নেটওয়ার্কে বেশ আগ্রহ ছিল। সে ভাবনা থেকেই কাজ করছি।

দলটির সুপারভাইজার ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের প্রভাষক রোয়িনা আফরোজ অ্যানি। বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন নিরিবিলি ফাল্গুনী হাউজিংয়ের ল্যাবে রোবটটি তৈরির যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হয়। রোবটটি তৈরিতে বিশেষ সহযোগিতা করেন উজ্জ্বল সরকার ও মাসুদ রানা।

রোবটটির প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে চাইলে গ্রুপের সদস্য মাহতাবুর রহমান সবুজ বলেন, এটি মূলত পোর্টেবল ও অটোমেটেড অর্থাৎ বাইরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই পূর্ণ কাজ করতে সক্ষম। সফটওয়্যার চালুর পর এটি নিজে নিজেই সব কাজ করতে পারে। রোবটের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং ক্যাপাবিলিটি তাকে বাইরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কাজ করার সক্ষমতা দিয়েছে। রোবটটি শুধু ভার্চুয়াল কাজেই নয়, শারীরিক কাজেও দক্ষ। এটি আঙুল, কনুই, কাঁধ, ঘাড়, মাথাসহ বিভিন্ন অঙ্গ নাড়াতে পারে। হাই-ফাইভ অথবা হ্যান্ডশেক করা, কফির কাপ রাখা, অঙ্গভঙ্গি করাসহ আরও অনেক কাজে এটি পটু। এছাড়া নানা ধরনের গেম খেলা ও কৌতুক শোনাতেও পারে ‘মিরা’। রোবট মিরার আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য মনে রেখে পরবর্তী সময়ে সে অনুযায়ী কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে মাথা থেকে কোমরের ওপর পর্যন্ত তৈরি হয়েছে, এখনো পা বসানো হয়নি বলে হাঁটতে পারে না মিরা।

রিফাত বলেন, রোবট মিরা তৈরিতে আমরা জাভা, পাইথনসহ নানা ধরনের প্রোগ্রামিং কোড ব্যবহার করেছি। এছাড়া ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিংয়ের জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ (এআইএমএল) কোড ও হার্ডওয়্যার কনফিগারেশনের জন্য ‘ডট কনফ (কনফিগারেশন) কোড’ ব্যবহার করেছি। সব মিলিয়ে কোডের দৈর্ঘ্য ১১ থেকে ১২ হাজার লাইন। এটি কোনো এক্সটারনাল কন্ট্রোল ছাড়াই কাজ করতে সক্ষম।

রিফাত আরও বলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম রাসবেরি পাই (সিঙ্গেল বোর্ড মিনি কম্পিউটার) দিয়ে ওর ব্রেন বানাব। কিন্তু ডেটা ও অ্যালগরিদম একসঙ্গে প্রয়োগ করে কাজ শুরুর পর খেয়াল করলাম, সিঙ্গেল বোর্ড কম্পিউটার সবকিছু নির্ঞ্ঝাটভাবে সামলাতে পারে না, বরং ওভারলোড বা ওভার হিট হয়ে যায়। অন্যদিকে দলের আরেক সদস্য মারুফের কোর আই-৭ ল্যাপটপটি ব্রেন হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। তাই এক্ষেত্রে সেটিই ব্যবহার করছেন তারা।

মাহমুদা আক্তার নিঝুম বলেন, আমাদের রোবটটি অনেকটা মানুষের আকৃতির। এজন্য শুধু সিএসই বিষয়ে জ্ঞানই যথেষ্ট ছিল না। চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিশেষ করে অ্যানাটমি নিয়েও আমাদের পড়াশোনা করতে হয়েছে। এছাড়া মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েও আমাদের ভাবতে হয়েছে। থ্রিডি প্রিন্টার না থাকায় বিকল্প উপায়ে রোবট মিরার স্ট্রাকচার তৈরি করেছি আমরা।

রোবট মিরাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কীÑএ প্রশ্নের উত্তরে আরেক কারিগর শারমিন নাহার তোহফা বলেন, মিরার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে সর্বপ্রথম বলতে হয় বাংলা ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং যুক্ত করা, যার মাধ্যমে মিরা বাংলাভাষী যে কোনো মানুষের কথা বুঝতে ও যথাযথ উত্তর দিতে পারবে। তাছাড়া আমদের ফুল বডি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। ফলে মিরা নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতে পারবে। আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষের মতো বিহেভিয়ার, মুভমেন্ট ও অঙ্গভঙ্গি করা, যাতে মিরার সঙ্গে যিনি কথা বলবেন তিনি যেন মনে না করেন কোনো মেশিনের সঙ্গে কথা বলছেন। তাছাড়া মিরার প্রোগ্রামেবল ভয়েস আরও উন্নত করব, যাতে সে বিভিন্ন পিচ-এ কথা বলতে পারে। এতে ব্যবহারকারী মিরার সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হবে। তাছাড়া টেলিপ্রেজেন্স ক্যাপাবিলিটি যুক্ত করতে চাই। এটি বাস্তবায়িত হলে মিরার ভেতরে ভার্চুয়ালি কেউ প্রবেশ করতে পারবে, মিরার চোখ দিয়ে দেখতে পারবে ও মিরার হাত-পা দিয়ে কাজ করতে পারবে।

  মো. জসিম উদ্দিন