রোহিঙ্গাদের নিতে আগ্রহী নয় তৃতীয় কোনো দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: মিয়ানমার থেকে উৎখাত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর সুযোগ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিনটি দেশকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কোনো দেশই গত কয়েক বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও গ্রহণ করতে আগ্রহ দেখায়নি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে এ তথ্য জানান পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক।

এদিকে রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশকে নানা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাবের মুখে ফেলেছে। চলতি অর্থবছরে দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের প্রায় সাত হাজার ১২৬ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।

গতকাল রাজধানীর খাজানা গার্ডেনিয়া হলে অনুষ্ঠিত সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, মিয়ানমারের কৌশল দেখে স্পষ্ট যে তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে ‘সমস্যার স্থায়ী সমাধান’ করতে চায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলের সবিস্তার ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৪৭ সালে আমরা দেখেছি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখদের নিশ্চিহ্ন করার দৃশ্য। আর পূর্ব পাঞ্জাবেও দেখা গেছে মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার দৃশ্য। সে সময় যারা ঘর ছেড়েছিল তারা আর তাদের ঘরে ফিরতে পারেনি। নেহরু-লিয়াকত প্যাক্টের আওতায় অনেক চেষ্টা সত্তে¡ও তাদের ঘরে ফেরানো যায়নি। এ অতীত মাথায় রেখে শরণার্থী সমস্যাকে অনুধাবন করতে হবে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক। এতে সাবেক ক‚টনীতিক, সেনা কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, উন্নয়নকর্মী, বিদেশি ক‚টনৈতিক কোরের প্রতিনিধিসহ স্টেকহোল্ডাররা উপস্থিত ছিলেন। এতে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনূপ কুমার চাকমা, ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. মুসা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ। সংলাপের শুরুতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশের কূটনীতিকরা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করছেন। আমরা অতীতের ঘটনাবলির সঙ্গে এবারের ঘটনার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে অনুধাবন করেছি যে, এবারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আগের চেয়ে ভিন্নতর। আমরা এর মোকাবিলার জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছি। অনেকেই তৃতীয় কোনো দেশে আশ্রিতদের পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরা সে চেষ্টা করেছি। আমি নিজে তিনটি দেশের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের কেউ একজন রোহিঙ্গা গ্রহণের বিষয়েও আগ্রহ দেখায়নি। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমস্যাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সৃষ্ট। আমরা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য যাইনি, বরং রাজনৈতিক ভ‚মিকার জন্য সবার কাছে গিয়েছি। কারণ রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

পররাষ্ট্রসচিব বলেন, একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়ে বেশ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আগামী ২২-২৩ তারিখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার যাচ্ছেন, সেখানে একটা ভালো অগ্রগতি আমরা আশা করছি। দ্বিপক্ষীয় এ উদ্যোগে সাফল্য না এলে অন্যান্য প্রচেষ্টার সুযোগ থাকবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী। তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রেখেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চাইতে হবে।

মূল প্রবন্ধে ড. ফাহমিদা খাতুন রোহিঙ্গা সংকটের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান ঘটনাবলি তুলে ধরে বলেন, এ সংকটের নানামুখী প্রভাব আমাদের আমলে নিতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর সেপ্টেম্বর মাসে সংকট শুরু হয়েছে। সেই থেকে বাকি ১০ মাসে বাংলাদেশকে সাত হাজার ১২৬ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। আগামী অর্থবছরেও প্রথম ফিসকালে এক হাজার ৩৫৬ কোটি এবং পরের ফিসকালে দুই হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এ অর্থায়নের সিংহভাগই সরকারকে নিজস্ব উৎস থেকে অর্থায়ন করতে হচ্ছে।

সংলাপে বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হলেও সেটি এখন বাংলাদেশের দিকে গড়িয়ে এসেছে। ইস্যুটিকে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে না রেখে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য একই সঙ্গে কঠোর ও কোমল ক‚টনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকারি কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য পর্যায়ের লোকদের সমস্যার সমাধানে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশকে এখন স্পষ্ট করতে হবে যে আমরা রোহিঙ্গাদের ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার ন্যাশনাল’ না বলে শরণার্থী বলা যায় কি না। সেটি করা গেলেই তাদের দেশের ফেরানোর প্রশ্নে আইনি যৌক্তিকতা সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশকে দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া শীর্ষ রাজনৈতিক প্রতিনিধিকে ভারত-চীনসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশে সফরেরও গুরুত্ব দেন তিনি। এটা করা গেলে বিশ্বমহলের অনুমান বদলে যেতে পারে বলে তিনি মত দেন।

বক্তারা আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে ঋণ গ্রহণ না করে আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া তাদের সহায়তা যেন বাংলাদেশের উন্নয়ন সহায়তা থেকে না দিয়ে আলাদাভাবে দেওয়া হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় বক্তারা আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি কক্সবাজার উপজেলার আশ্রয়দাতা নাগরিকদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্যও সহায়তার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০