Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 1:32 pm

রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধের রায় বাস্তবায়ন হোক

মাহমুদুল হক আনসারী: পৃথিবীতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী চরমভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছে, সেটা আরেকবার আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো। রাখাইনে দফায় দফায় নির্মমভাবে সে অঞ্চলের শত বছরের একটি জাতিগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার গভীর ষড়যন্ত্র ২০১৭ সালে পরিচালনা করে সে দেশের সেনাবাহিনী। তখন শিশু, নারী, পুরুষ ও সব বয়সের মানুষের ওপর চরমভাবে নির্যাতন পরিচালিত হয়। নারী-পুরুষকে জলন্ত আগুনে পুড়ে মারা হয়। যুবতী নারীদের শ্লীলতাহানি করা হয়। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অসংখ্য মানুষকে তখন কেটে টুকরো টুকরো করে উল্লাস পর্যন্ত উদযাপন করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগণের কোনোদিকে আশ্রয় পাওয়ার মতো জমি ছিল না। পুরো মিয়ানমারজুড়ে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ঘেরাও করে পাড়া-মহল্লায় তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। সহায় সম্পত্তি সবকিছুই তাদের হাতে ছিল না। তখন তারা হয়ে পড়ছিল অসহায় নির্যাতিত বাস্তুভিটা হারা এক অভাগা জাতি। আশেপাশের প্রতিবেশী দেশ তখন শুধু তামাশাই দেখছিল। কেউ তাদের পাশে এগিয়ে আসেনি। সে করুণ মানবতাবিরোধী জঘন্য জাতি বিধ্বংসী ইতিহাসের বর্বোরচিত এ কার্যকলাপের গভীর নিন্দা এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। সেদিন আশ্রয়হীন লাখ লাখ রোহিঙ্গা শিশু-নারী বাস্তুভিটাহারা মজলুম মানুষগুলোকে মানবিক কারণে বাংলাদেশ  বর্ডার খুলে দিয়ে তাদের আশ্রয় প্রদান করে।

বাংলাদেশ ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের সঙ্গে সর্বদা সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। সর্বদা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সুসম্পর্ক রাখতে চায়। বাংলাদেশ কারও সঙ্গে বৈরী আচার-আচরণ করার মাধ্যমে সম্পর্কের অবনতি আশা করে না। সেদিন যদি লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় না দিত তাহলে হয়তো একজন রোহিঙ্গা মানুষকেও জীবন্ত দেখা যেত না। নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচারী জালিম অং সান সু চি যে বর্বরোচিত নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে যা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালিয়েছে, সেটা একটু সময় বেশি হলেও পৃথিবীর শাসকগোষ্ঠী দেখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী ঐতিহাসিক এক সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গা লাখ লাখ নারী-শিশুকে আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বুকে মানবতাবাদী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৭ সালের পর থেকে রোহিঙ্গাদের যে ঢল এবং শিবির তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের কক্সবাজার, টেকনাফ অঞ্চলে সেটা দেখতে পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যারা তাদের দেখে যায়নি। মজলুম এ মানুষগুলোর খাওয়া-দাওয়া, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা স্যানিটেশনসহ সব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার অতি যতœ ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে তাদের পরিচর্যা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নৈপুণ্য দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করে যাচ্ছে। কক্সবাজার এলাকার জনগণ তথা বাংলাদেশের জনগণ রোহিঙ্গা জনগণের পাশে সার্বিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে নয়, মানবিক কারণে একটি জাতিকে ধ্বংস থেকে বাঁচাতেই বাংলাদেশ ও তার জনগণ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ সেদিন থেকে অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝাতে চেষ্টা করেছে, রোহিঙ্গারা নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার। ধর্মীয় কারণে তাদের ওপর এ নির্যাতন। শত বছরের কাগজের দলিলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক সেটা প্রমাণিত ও দালিলিক। তবুও তারা যখন নির্যাতিত সে দেশের অত্যাচারী সামরিক জান্তার শোষণে।

বাংলাদেশ সরকার উদ্বাস্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। কয়েক দফা বৈঠকে প্রস্তাব আর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ওপর। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সেসব চুক্তি ও বক্তব্য বাস্তবায়ন করছে না। চালবাজ-ক‚টচাল মিয়ানমার যেনতেনভাবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশেই রেখে দিতে চায়। নানা কর্মকৌশলে রোহিঙ্গা বিশাল এ জমিকে জনবিচ্ছিন্ন করে মিয়ানমার ইতোমধ্যে সেখানে শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে শক্তিশালী কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করারও তথ্য জানা যায়। উন্নত উর্বর এ জমি খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ একটি এলাকা বলে জানা যায়।

যা-ই হোক, কিছু সময় দেরিতে হলেও বিশ্ব বিবেক এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতিত জনগণের পক্ষে শক্তিশালী ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। সঙ্গে রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে যে সখল রোহিঙ্গা বাস করছেন তাদের সুরক্ষা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশও দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডসের হ্যাগে স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টায়) অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশবিষয়ক এ রায় দেন আইসিজের প্রেসিডেন্ট আবদুল কাওয়াই আহমেদ ইউসুফ। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তিনি রায় ঘোষণা করেন। আইসিজের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে রায়টি সম্প্রচার করা হয়। গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর তিন দিনব্যাপী নেদারল্যান্ডসের হেগে এ মামলার শুনানি হয়। এতে মিয়ানমারের পক্ষে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি উপস্থিত ছিল। সে সময় সু চি রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে।

আদালতের মাধ্যমে জানা যায়, গণহত্যা কনভেনশনের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার রাখে। ডিসেম্বরে মামলার শুনানিতে সু চি জানায়, সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির বিরুদ্ধেই মূলত ২০১৭ সালে রাখাইনে সেনা অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। এসব বক্তব্য অং সান সু চির ছিল। মূলত আত্মপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে সু চির উপরোক্ত বক্তব্য। সেটা আদালত গ্রহণ করেনি। আদালত বলেছেন, ২০১৭ সালে মিয়ানমার যে সেনা অভিযান চালায় তাতে হাজার হাজার নিরীহ শান্তিকামী মানুষ শিশু-নারী নির্মমভাবে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের বক্তব্য, সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা জনগণ পার্শ^বর্তী দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। ব্যাপক হারে হত্যা, ধর্ষণ, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য ও গণহত্যা কনভেনশনে উল্লিখিত গণহত্যার সংজ্ঞা অনুসারে মিয়ানমারে রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন সহিংসতার অভিযোগ উঠেছে, তা গণহত্যার সঙ্গে সাদৃশ্য পূর্ণ বলে জানান আদালত। এখনও মিয়ানমারে ছয় লাখের অধিক বিপন্ন রোহিঙ্গা আছে বলে আদালত জানিয়েছেন।

আদালত চারটি অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ বাস্তবায়ন চায় বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ। বাংলাদেশ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে অন্যায় করেনি। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু মানবপ্রিয় মানবদরদি ছিলেন। তিনি বাঙালি জাতিকে মুক্ত করতে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এবং ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশ শোষণ-জুলুম আর  নির্যাতন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশ সবসময় নির্যাতিত নিষ্পেষিত মজলুম ও মানবতার পক্ষে  কথা বলে। বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও মানবতার পক্ষের একটি আদর্শের নাম। তাই তিনি নির্যাতিত রোহিঙ্গা মজলুম মানুষের পক্ষ থেকে তাদের বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় দিয়েছেন। আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভ‚ষিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব। গোটা পৃথিবীর মালিক সৃষ্টিকর্তা। সব সৃষ্টির রক্ষাকারী তিনিই। তাঁর হুকুম-ইশারা ছাড়া কিছুই এদিক-ওদিক হবে না। সুতরাং পৃথিবীর মানুষ সে যে অঞ্চলেই থাকুক না কেন, তাকে নিরাপত্তা, মানবতা ও নাগরিক অধিকার দেওয়া সে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তাই উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের মানবিক নৈতিক ও নাগরিক সব ধরনের অধিকার দিয়ে তাদের ফেরত নেবেনÑসে প্রত্যাশা রাখছি মিয়ানমার ও  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি।