Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 1:08 am

রোহিঙ্গা সংকট ও বাংলাদেশের অবস্থান

২০১৭ সালে মিয়ানমারে সেনাশাসিত সরকারের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রবেশের পর সমস্যাটি যে এত জটিল হয়ে উঠবে, তা অনেকের ভাবনায়ও ছিল না।  রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ অবস্থানের ফলে নানা রকম আর্থসামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হওয়ায় শিবিরে রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা ও বঞ্চনা বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বৈষয়িক টানাপড়েন ও মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে জনসংখ্যাগত যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে পারস্পরিক অসন্তোষ ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা, বাংলাদেশের পাসপোর্ট তৈরি করা, এমনকি ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তিকরণের তৎপরতায় তাদের লিপ্ত হওয়ার খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসছে। তাদের কারণে বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দারা জš§নিবন্ধন ও ভোটার আইডি কার্ড পেতে হরহামেশা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষত বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানা এলাকায় ঢুকে পড়ছে। এটা স্থায়ী বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য মারাত্মকভাবে হুমকির সৃষ্টি করেছে। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর একটি আবদ্ধ স্থানে কর্মহীন অবস্থায় বসবাস করার কারণে তাদের মধ্যে একধরনের হতাশাও লক্ষ করা যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কেননা একদিকে মিয়ানমার মানবাধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণা ও সনদগুলোকে ক্রমাগতভাবে অস্বীকার করে চলেছে; অন্যদিকে প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের গণহত্যা থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশনের বাস্তবিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলো তাদের ভ‚-কৌশলের বিষয়গুলোকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তেমন কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে পারছে না। এদিকে মিয়ানমারের ক্রমাগত অসহযোগিতার কারণেও বাংলাদেশের একার পক্ষে এই সংকটের সমাধান বের করা সম্ভব নয়।

তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়েই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিন্মোক্ত ব্যবস্থাগুলো নেয়ার মাধ্যমে এই সংকটের একটি সমাধানের দিকে আমরা যেতে পারি প্রথমত, মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে বৈশ্বিক ঐকমত্য সৃষ্টির প্রয়াস চলমান রাখা। দ্বিতীয়ত, আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য প্রভাবশালী দেশগুলো যেন মিয়ানমারকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে, সে লক্ষ্যে ক‚টনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য আসিয়ান ও ওআইসির উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সংলাপ শুরু করার জন্য বাংলাদেশকে উদ্যোগ নিতে হবে। এ লক্ষ্যে ঢাকায় কিংবা এসব দেশের রাজধানীগুলোয় ধারাবাহিকভাবে বৈঠক হতে পারে। চতুর্থত, দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সংলাপে আলোচনা ও মতৈক্যের বিষয়গুলোয় রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক দাবিদাওয়াকে (যেমন তাদের নৃতাত্তি¡ক পরিচয়ের স্বীকৃতি, নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার, জমি ফিরে পাওয়া এবং প্রত্যাবাসনের পর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রভৃতি) গুরুত্ব দিতে হবে, যেন স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। রোহিঙ্গাদের সসম্মানে নাগরিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে মিয়ানমারকে এসব নাগরিক গ্রহণ করতে বাধ্য করতে হবে।

১৯৪৮ সালে স্বাক্ষরিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র এবং ২০০৫ সালের ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট (আরটুপি)’ বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তাদের বাধ্যবাধকতা অস্বীকার করতে পারে না। সুতরাং জাতিসংঘকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। সেইসঙ্গে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পর অন্ততপক্ষে প্রথম তিন বছর পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে রাখতে হবে। বাংলাদেশের সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে সর্বদাই তৎপর রয়েছে। দেশের জনগণ দ্রুত সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমারে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন চায়।

মাহমুদুল হক আনসারী

মুক্ত লেখক, চট্টগ্রাম