Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 8:30 pm

র‌্যাগিং আতঙ্কে ক্যাম্পাস ছাড়ছেন হাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা!

মো. রুবাইয়াদ ইসলাম, হাবিপ্রবি: দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) র‌্যাগিংয়ের শিকার নবীন শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ছাড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন আর্কিটেকচার বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া ২২ ব্যাচের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান। এর আগে প্রতি বছর কোনো না কোনো নবীন শিক্ষার্থী র‌্যাগিংয়ের ভয়ে ছেড়েছেন ক্যাম্পাস।

জানা গেছে, গত বছর বরগুনা থেকে আগত ২১ ব্যাচের ফিসারিজ অনুষদের সানাউল্লাহ্, তার আগের বছর চট্টগ্রাম থেকে আগত ২০ ব্যাচের অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শাহরিয়ার ও নেত্রকোনার ১৯ ব্যাচের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সিয়াম র‌্যাগিং সইতে না পেরে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। তাদের বাইরেও অনেক শিক্ষার্থী র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে নীরবে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন।

নির্যাতিত এসব শিক্ষার্থীর বর্ণনায় ফুটে উঠেছে অগ্রজদের ভদ্রতা শেখানোর নামে নির্যাতনের চিত্র। মূলত বছরের পর বছর এভাবে র‌্যাগিং ঐতিহ্য চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিবাদ করলে নবীন শিক্ষার্থীদের বয়কটের নামে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় বন্ধুদের কাছ থেকে। নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব শিক্ষার্থী নীরবে র‌্যাগিং সহ্য করেন তাদের অনেকে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে নিজ বিভাগের নিচের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের অপেক্ষায় থাকেন। মূলত এভাবে র‌্যাগিং সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে হাবিপ্রবিতে।

নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সানাউল্লাহ বলেন, ক্যাম্পাসের পাশে নতুন মেস উঠেছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় বড় ভাইরা ডেকেছিলেন। আমরা ৯ থেকে ১০ জন ছিলাম। ওনারা প্রথমে আমাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করালেন। এরপর শুরু হলো, এটা ওটা নিয়ে ভুল ধরা, মিলিটারি ভঙ্গিতে দাঁড় করানো, কথায় কথায় গালিগালাজ, শূন্যের মধ্যে চেয়ারের ওপর বসাসহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

পরে সানাউল্লাহ্ র‌্যাগিং সইতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসার উদ্দেশে রওনা হন। সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাতিল করে ঢাকার একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন তিনি।

১৯ ব্যাচে ভর্তি হয়ে পরে ভর্তি বাতিল করা আরেক শিক্ষার্থী ফকির আলমগীর সিয়াম বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের দ্বিতীয় নামকরা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়তে এসেছিলাম। সিনিয়র ভাইরা কাউকে টিকটিকি, কাউকে মুরগি বানিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মজা করতেন। স্ট্যাম্পের ওপর বসানো, কানে ধরিয়ে রাখা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুমের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করাসহ রাতভর আজগুবি সব স্টাইলের নির্যাতন করতেন বিভিন্ন বিভাগের সিনিয়ররা। এখন নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করি যেখানে না আছে হল সুবিধা, না আছে ক্যাম্পাসের তেমন কোনো সুবিধা। অশ্রুসজল চোখে সিয়াম বলেন, আজও হাবিপ্রবিকে আমি মিস করি। হাবিপ্রবির বন্ধুদের মিস করি।

এদিকে রিয়াদের বাবা মফিজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করে, টিউশনি করে, নিজের আয়ে ছেলেটা আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। সামান্য বেতনের চাকরি করে এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে গিয়ে এ কোন বিপদে পড়ল ছেলেটা।

তিনি আরও বলেন, বড় ভাইদের সালাম না দিলে গায়ে হাত তুলবে, এটা কোন ধরনের আচরণ! সবাই লেখাপড়া করতে গেছে, ভালোভাবে থাকবে, পড়ালেখা করবে। তা না করে সন্ত্রাসী আচরণ করা; এটা তো ঠিক না।

ছেলেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিজে বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি। অনেক বড় স্বপ্ন ছিল, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমার ছেলে মেধায়ও অনেক ভালো। কোনো দিন ওর মতের বিরুদ্ধে আমরা কিছু বলিনি। রিয়াদ সব সময় তার ভালো-মন্দ নিজেই বিচার করেছে। সে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিতভাবে তার অসুবিধার কথা জানিয়েছে। এখন বিষয়গুলোর সমাধান হলে, শিক্ষকদের কাছে আশ্বাস পেলে ছেলেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার বিষয়ে রিয়াদ বলেন, এখনও স্যারদের ওপরে ভরসা রাখছি। চেয়ারম্যান স্যার ও প্রক্টর স্যার ফোন করেছিলেন। ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে বলেছেন। বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেব।

আর্কিটেকচার বিভাগের চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব মো. শাহরিয়ার এ ব্যাপারে বলেন, ইতোমধ্যে আপনারা হয়তো জানেন যে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা তার নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করব। আমরা কখনও চাই না কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এভাবে চলে যাক। আমরা তাকে ডেকেছি এবং তাকে আশ্বস্ত করেছি। আমরা তার প্রত্যেকটা বিষয় খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করব। আমরা তাকে বোঝাতে চাই যে সে এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মামুনুর রশীদ বলেন, ওই শিক্ষার্থীকে আমি বেশ কয়েকবার ফোন করেছি। আশা করি সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছি।

উল্লেখ্য, র‌্যাগিং নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মেসগুলোয় প্রতিনিয়ত টহল দিচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী র‌্যাগিং প্রমাণিত হলে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বহিষ্কার করার নিয়ম রয়েছে।