Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:26 am

র স না লো ভ ন: টাঙ্গাইলের চমচম

 

কেবল উদরপূর্তিই নয়, খাওয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা বরাবরই ছিল, আছে বাঙালির চিন্তায়, রুচিতে। খাওয়ার পদবৈচিত্র্য তাই এ জনপদজুড়ে। দেশের নানা স্থানের বিশেষ বিশেষ খাবারের কথা জানাচ্ছেন মীর মাইনুল ইসলাম

যে কোনো শুভ কাজ বা সংবাদে মিষ্টির

ব্যবহার অনেক পুরোনো। বিয়ে, পরীক্ষায় পাসের খবর, সন্তান জš§, কোনো শুভসূচনা বা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, অতিথি আপ্যায়নসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে খাদ্যতালিকায় থাকে মিষ্টি। মিষ্টি যেন মিশে আছে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে। চমচম, রসগোল্লা, সন্দেশ, রাজভোগ, ক্ষীরমোহন, মতিচূড়, কালোজাম, লাড্ডু, রসমালাই, পানতোয়া, বালিশ, আমিত্তি, জিলেপি, ভুবনেশ্বর, কাঁচাগোল্লা এমনসব বাহারি নামের মিষ্টির সমারোহ দেখতে পাওয়া যায় আমাদের দেশে।

কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও রয়েছে মিষ্টিগুলোর ভিন্নতা। তবে এত এত পদের মধ্যে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে বলা হয় মিষ্টির রাজা। স্বাদের দিক দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচমের সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। টাঙ্গাইল জেলার পোড়াবাড়িতে সুস্বাদু এ মিষ্টির জš§।

পোড়াবাড়ির চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাহিরটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়।

 

যেভাবে বিখ্যাত হয়

পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রায় দুইশ বছরের পুরোনো ইতিহাস। গবেষকদের মতে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলে যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার সুস্বাদু পানি ও গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথম চমচম তৈরি করেন। পরে এখানেই ব্যবসা শুরু করেন। এর আগে ১৬০৮ সালে পোড়াবাড়ি গ্রামটিকে নদীবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সে সময়কালে ধলেশ্বরীর পশ্চিম তীরে গড়ে উঠেছিল জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র, পোড়াবাড়ি বাজার। তখন পোড়াবাড়ি ঘাটে ভিড়তো বড় বড় সওদাগরি নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার। এ প্রাণচঞ্চলতায় যোগ হয় সুস্বাদু চমচম, গড়ে ওঠে মিষ্টির বাজার।

প্রতি সপ্তাহে ১৫০ থেকে ২০০ চমচম তৈরি হতো পোড়াবাড়িতে। উত্তরোত্তর সাফল্য ও চাহিদার কারণে তখন পোড়াবাড়িতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে পাঁচ শতাধিক পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্ভর করতো। দশরথ গৌড়ের পর আসেন রাজারাম গৌড়, কুশাই দেব, নারায়ণ ঘোষ, কাকন হালুই, শিবশঙ্কর গৌড়, প্রকাশ চন্দ্র, মদন গৌড়, মোহন লাল প্রমুখ। বর্তমানে খোকা ঘোষ ও গোপাল চন্দ্র দাসের নাম উল্লেখযোগ্য।

তৈরির উপাদান

সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা। তবে এটি তৈরিতে টাঙ্গাইলের পানি দরকার। অর্থাৎ টাঙ্গাইলের চমচম তৈরির মূল রহস্য এখানকার পানির মধ্যে নিহিত।

 

আশঙ্কা ও আশা

ঐতিহ্যবাহী পোড়াবাড়ির চমচম আজ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন। অনেক মিষ্টি নির্মাতা ও ব্যবসায়ী আর্থিক ক্ষতির কারণে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে একসময় পোড়াবাড়ির চমচম হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে আশার কথা, চমচম এখনও একটি উপাদেয় মিষ্টান্ন। এটি অনেকের কাছেই প্রিয় একটি খাবার। দেশজুড়ে এর রয়েছে ব্যাপক চাহিদা ও সুখ্যাতি। সারা দেশেই পাওয়া যায় এ মনোলোভা মিষ্টান্নটি।