শুধু রসনাবিলাস নয়, খাওয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা বরাবরই ছিল, আছে বাঙালির চিন্তা ও রুচিতে। খাওয়ার পদবৈচিত্র্য তাই এ জনপদজুড়ে। এবার মেহেপুরের সাবিত্রী ও রসকদম্বের কথা জানাচ্ছেন শিপন আহমেদ
আদিকাল থেকেই মিষ্টির প্রতি টান রয়েছে বাঙালির। দেশি কারিগরদের হাত ধরে এদেশে বিভিন্ন সময় ভিন্ন স্বাদের মিষ্টির উদ্ভাবন হয়েছে। আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টিগুলোর মধ্যে মেহেরপুরের ঐতিহ্যবাহী রসকদম্ব ও সাবিত্রী জনপ্রিয়।
১৮৬১ সালে ব্রিটিশ রাজত্বকালে প্রাচীন শহর মেহেরপুরের আদি বাসিন্দা বাসুদেব এই মিষ্টি উদ্ভাবন করেন। খড়, টালি ও টিন দিয়ে নির্মিত তার বাড়ির একাংশে ছিল মিষ্টির দোকান। আজ সেখানে দোতলা দালানের নিচতলায় ‘বাসুদেব গ্র্যান্ড সন্স’ নামে বাসুদেবের দুই নাতি বিকাশ কুমার সাহা ও অনন্ত কুমার সাহা মানুষের রসনা সেবা করে যাচ্ছেন। সময়ের হিসাবে তা পেরিয়ে গেছে প্রায় ১৫০ বছর।
অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার পাঁচ মহকুমার মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক নগরী ছিল মেহেরপুর। এ অঞ্চলের জমিদার সুরেন বোসের জমিদার বাড়ির সামনে বাসুদেবের সাবিত্রী ও রসকদম্ব দোকানের অবস্থান। বাণিজ্যিক নগরী ও জমিদার বাড়িতে মাঝেমধ্যেই আসতেন ব্রিটিশ রাজ্যের অমাত্যবর্গ, রাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, গণ্যমান্য অতিথি ও অন্য অঞ্চলের জমিদাররা। সুরেন বোস সেই অতুলনীয় স্বাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন আগতদের। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো নদীয়া জেলায় ভিন্নধর্মী ও ব্যতিক্রমী এ মিষ্টির পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া তখনকার মন্ত্রী, এমপি, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, বিদেশি কূটনীতিক ও বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি মেহেরপুরে এলে তাদের আপ্যায়নের প্রধানতম মিষ্টান্ন ছিল সাবিত্রী ও রসকদম্ব। এ মিষ্টি স্বাদে অতুলনীয়, গুণে ও মানে অদ্বিতীয়।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এতে অন্য মিষ্টির মতো রস নেই। দুধের চাছি ও চিনি মূলত এই মিষ্টি তৈরির উপকরণ। অন্য কোনো উপকরণ ব্যবহার করা হয় না। এর সবচেয়ে বড় দিক চুলায় জ্বাল দেওয়ার বিষয়টি। নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী নির্ধারিত তাপে মিষ্টির চুলায় জ্বাল দিতে হয়। সুচারুভাবে জ্বাল দেওয়ার কাজটি করতে হয়। মজার ব্যাপার হলোÑএগুলো যত পুরোনো হয়, তত এর স্বাদ বাড়ে। ফ্রিজে না রেখে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া যায়।
সাবিত্রী ও রসকদম্ব মিষ্টি দুটি এখন শুধু দেশে নয়, খ্যাতি ছড়িয়ে সুনাম অর্জন করেছে ইউরোপ, আমেরিকা, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
মজার বিষয়, এই মিষ্টি তৈরি বংশপরম্পরায় সীমাবদ্ধ। বাসুদেবের বংশধরদের ছাড়া বাইরের কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয় না। নিজেরাই মালিক, নিজেরাই কারিগর। পরিবর্তন হয়েছে মানুষের, সমাজের, এমনকি দেশেরও। যিনি এই কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি বেঁচে নেই। মিষ্টি তৈরির কৌশল কেউ জানতে চাইলে তারা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। সাধারণত অর্ডার ছাড়া মিষ্টি খুব কম তৈরি করেন। বেলা ৩টার পর আর কোনো মিষ্টি অবশিষ্ট থাকে না দোকানে।
জেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রসকদম্ব ও সাবিত্রী ছাড়া অনুষ্ঠান যেন চলেই না! বাইরের কোনো জেলার মেহমান এলে রসকদম্ব ও সাবিত্রী খাওয়াতে পছন্দ করে এখানকার মানুষ। এমনকি বাইরে কোনো উপহার পাঠাতে রসকদম্ব ও সাবিত্রী পেলে অন্য বিকল্প ভাবে না। এ জেলার প্রবাসীরা বাসুদেবের মিষ্টি সঙ্গে নিয়ে যান। কারণ বাংলাদেশে কোথাও এই সুস্বাদু মিষ্টি পাওয়া যায় না।