ইসমাইল আলী: দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম থেকে কেনা ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিনে দরপত্রের শর্তানুসারে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়নি। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এসব ইঞ্জিন। এজন্য হুন্দাই রোটেমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। তবে দুই মাসের পেরিয়ে গেলেও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো লকডাউনে সরকারি সব অফিস বন্ধ থাকলেও গোপনে ইঞ্জিনগুলোর মূল্য পরিশোধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে। এজন্য গত মাসে নিয়োগ দেয়া হয়েছে নতুন প্রকল্প পরিচালক। তিনি এ লকডাউনের মাঝেই ইঞ্জিনগুলোর ট্রায়াল রান (পরীক্ষামূলক চলাচল) করাচ্ছেন। অথচ আট মাস আগে এক দফা ট্রায়াল রান করা হয়েছিল। সে সময়ই ইঞ্জিনগুলোয় সর্বোচ্চ গতি তোলা যায়নি।
সূত্রমতে, ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনায় দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১৭ মে চুক্তি করে রেলওয়ে। চুক্তিমূল্য ছিল তিন কোটি ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪০০ ডলার। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দেয়া হয়। বাকি অর্থের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো দেশে আসার পর ৬৫ শতাংশ ও গুণগত মান যাচাইশেষে বাকি ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের কথা ছিল। তবে নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ আটকে দেন প্রকল্পটির তৎকালীন পরিচালক নূর আহম্মদ হোসেন।
নিম্নমানের ইঞ্জিন গ্রহণে অস্বীকৃতিও জানান তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেয়া হয়। এতে হুন্দাই রোটেম ও প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেক্টর সিঙ্গাপুরের সিসিআইসির বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়। পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়েছে। রেলপথ সচিবের কাছে সে প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে দুই মাসের বেশি সময় ধরে তা গোপন করে রাখা হয়েছে। আর হুন্দাই বা সিসিআইসি কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
যদিও ২৩ মার্চ আরেকটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয় ইঞ্জিনগুলো চালানোর উপযুক্ত কি না যাচাইয়ের জন্য। এর এক সপ্তাহ পর ১ এপ্রিল আগের প্রকল্প পরিচালককে বদলি করে দেয়া হয়। আর ৪ এপ্রিল থেকে নতুন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ হাসান মনসুর।
এদিকে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ এপ্রিল সীমিত আকারে লকডাউন তথা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। সে সময় সরকারি প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আর ১৪ এপ্রিল থেকে চলাচলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা (লকডাউন) আরোপের পর সরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে রেলওয়ের সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা করে যাচ্ছে রেলওয়ে।
যদিও লকডাউনের মাঝেই কোরিয়া থেকে আনা নিম্নমানের ইঞ্জিনগুলো আবার ট্রায়াল রান করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটি ইঞ্জিন দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে কনটেইনারবাহী ট্রেন চালানো হয়েছে। এর মাধ্যমে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের জন্য প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। আর চলতি সপ্তাহেই ইঞ্জিনগুলোর মূল্য বাবদ চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, কারিগরি কমিটিতে ইঞ্জিনগুলোর তথ্য উপস্থাপনের জন্য ট্রায়াল রান করা হচ্ছে। প্রতিটি ট্রিপ শেষে এগুলোর পারফরম্যান্স, ট্রাভেল টাইম, সর্বোচ্চ গতি প্রভৃতি নোট রাখা হচ্ছে। কারিগরি কমিটি এগুলো দেখে যে সুপারিশ করবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
লকডাউনের মাঝেই ইঞ্জিনের মূল্য পরিশোধের বিষয়ে তিনি বলেন, ১০টি ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত। তাই এর আগেই ইঞ্জিনের মূল্য পরিশোধ করে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্যথায় তা আরও এক বছর ঝুলিয়ে রাখতে হবে। তবে লকডাউনের কারণে প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে।
ইঞ্জিন গ্রহণের বিষয়ে জানতে কারিগরি কমিটির সদস্য ও বাংলদেশ রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল) মো. বোরহান উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ইঞ্জিনগুলো এখনও গ্রহণ করা হয়নি। আগে পারফরম্যান্স যাচাই করে দেখা হবে, তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এদিকে দুই মাস পেরিয়ে গেলেও হুন্দাই রোটেম বা সিসিআইসির বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বা তদন্ত প্রতিবেদন কেন প্রকাশ করা হয়নি, তা জানতে রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পাশাপাশি এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি। এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
প্রসঙ্গত, গত বছর ৯ ডিসেম্বর ‘রেলওয়ের ১০ ইঞ্জিন কেনায় অনিয়ম: নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় শেয়ার বিজে। পরে ১৮ জানুয়ারি ‘রেলের নিম্নমানের ১০ ইঞ্জিন কেনা: প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত কমিটি, হুন্দাই রোটেমের অসহযোগিতা’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এছাড়া ৬ মার্চ ‘রেলওয়েকে নিম্নমানের ১০টি ইঞ্জিন সরববরাহ: দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ’ শীর্ষক তৃতীয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আর সর্বশেষ ২ এপ্রিল শেয়ার বিজে প্রকাশিত হয় ‘রেলওয়েকে নিন্মমানের ১০টি ইঞ্জিন সরববরাহ শাস্তি হয়নি কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের, পিডিকে বদলি’ শীর্ষক প্রতিবেদন।